চিনাকী বনাম নন্দবী : রাজনীতির ইসলামী মিত্র
লিখেছেন : মুফতি আবদুল্লাহ আল মাসুদ
জামায়াত-বিএনপির বিকল্প আওয়ামীলীগ নয়। আওয়ামীলীগের বিকল্প জামায়াত-বিএনপি নয়। সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দেশের অধিকাংশ নাস্তিকেরাই বিকল্পবাদী। কেউ কেউ যেকোন মূল্যে এই স্বৈরাচারী সরকারকে হঠাতে হবে এমন মতাদর্শে বিশ্বাসী, অর্থাৎ এককথায় তাঁরা জামায়াত-বিএনপিকে ক্ষমতায় আনতে বিশ্বাসী। আমার জানতে ইচ্ছে হয়, জামায়াত-বিএনপি কি নাস্তিকদের দল?
আরেকদলের বক্তব্য হচ্ছে, এ সরকারকে অপসারণ করলেই তো জামায়াত-বিএনপি ক্ষমতায় আসবে, সুতরাং এই সরকারের দুঃশাসন, নিপীড়ন, দুর্নীতি সবকিছু মুখ বুঝে মেনে নিন না! একটু মেনে নিলে অসুবিধা কি? কি অপূর্ব আবদার!
কোন কোন নাস্তিক আছে আরও একটু সরেস। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, নাস্তিকদের উচিত এখন সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া আর ধর্মের বিরুদ্ধে কথা কম বলা। কেউ কেউ আবার এর উল্টোটা। তাদের কথা হচ্ছে, আসুন আমরা এই সরকারের প্রগতিশীল দিকগুলো তুলে ধরি, এই সরকার সরকারের পক্ষে নৃত্য-সংগীত করি। আহা কি মিষ্টি আবদার! এই লোকগুলোকে আমার ‘মেড ইন ইন্ডিয়া, মেড বাই চায়না’ বলতে ইচ্ছে হয়। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ইসলামিক জি হা দে র আইডিওলজি বিক্রি করার জন্য ভারতের ভূমিকে ব্যবহার করে, আর ইসলামিক জি হা দে র প্রাক্টিসিং ময়দান হিসেবে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের ভূমিকে ব্যবহার করে।
কথা খুব সোজা; এবং সোজাভাবেই আমাদের বুঝতে হবে। লীগ-বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী এরা কেউই নাস্তিকতা কিংবা প্রগতিশীলতার ধারক এবং বাহক নয়। হাসিনা এবং খালেদা এ দুজনই ইসলামী অনুভূতির রক্ষক। যে লীগে তাহের, শামীম ওসমান সহ লাখ লাখ উগ্র মুসলিম আছে, যে লীগের প্রত্যেকটা কর্মীই ইসলামে অগাধ বিশ্বাস রাখে এবং মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করে সেই লীগ প্রগতিশীলতার ধারক ও বাহক হতে পারেনা। যে বিএনপি-জামায়াতে মাহমুদুর রহমান, পিনাকী ভট্টাচার্য, মেজর দেলোয়ার, কনক সারওয়ার, আবুল আলা নন্দবী, শহিদুল আলম হুজুররা আছেন সেই দলও মুক্তচিন্তার ধারক ও বাহক হতে পারে না। আর দু’চারটে প্রগতিশীলতার কথা সেটা শেখ হাসিনাও বলেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বলেন। মা দুর্গার শরণাপন্ন হাসান মাহমুদও যেমনি হন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও তেমনই হন। সুতরাং মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মা দুর্গার সভায় হাজির হয়ে অসাম্প্রদায়িক কথা বলার কোন মূল্য নেই, কারণ তাদের দলের বুদ্ধিজীবী এবং বুদ্ধিবৃত্তি মূলত হুজুরদের উস্কানি দেয়ার উপরেই নির্ভরশীল। আর উস্কানি দাতা হিসেবে মাহমুদুর রহমান এবং চিনাকী ভট্টাচার্যের সাগরেদরা বেশ ভালো দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন। একই সাথে হাসান মাহমুদের অসাম্প্রদায়িক দু’চারটে কথার কোন মূল্য নেই, কারণ তাঁর ভাইয়ের নেতৃত্বেই বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপরে নির্যাতন হয়েছে এমন ঘটনা আমরা জানতে পেরেছি। তাঁর দলের লোকেরাই এখন মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণে ইতিহাসের সকল রেকর্ডকে ব্রেক করে ফেলেছে। আর মডেল মসজিদ নির্মাণের খবর তো আমরা জানিই।
যারা কেবল একপক্ষের বক্তব্য শোনে তারা অন্ধ। আমরা দেখতে পাই, “এই সরকার নাস্তিকদের সরকার, ভারতের দালাল, ইজরায়েলের মোসাদের তল্পিবাহী” এসব গল্প দিয়ে বেড়াচ্ছেন ভদকাপ্রেমী কতিপয় দাড়িকাটা গোঁফছাটা বিএনপি-জামায়াতীরা। অপরদিকে সাইয়েদ আবুল আলা নন্দবী “এই সরকার জঙ্গিদের মদদদাতা, জিহাদিদের পৃষ্ঠপোষক, নাস্তিকদের খুনি” ইত্যাদি বলে বলে মুখের তুবড়ি ছোটাচ্ছেন। মুর্খ লোকেদের সমস্যা হচ্ছে তারা কেউ চিনাকী হুজুরের ভক্ত (অধিকাংশই মাদ্রাসার ছাত্র) আর কেউ নন্দবী হুজুরের ভক্ত। এরা অধিকাংশই হুজুগে নাস্তিক। হুজুগ দিয়ে ধর্ম হয়, হুজুগ দিয়ে নাস্তিকতা হয় না। হুজুগের কথা বিশ্বাস করলে ধার্মিক বেহেশতে যায় (সে বিশ্বাস করে), কিন্তু হুজুগের কথা বিশ্বাস করলে নাস্তিক ধার্মিকে রূপান্তরিত হয়।
যখন কোন মুসলিম বলে হিন্দু ধর্মের কোন ভিত্তি নেই তখন আমি তাঁর সাথে একমত হই। যখন কোন হিন্দু বলে ইসলামের কোন ভিত্তি নেই তখন আমিও তাঁর সাথে একমত হই। এবং আমি ঘোষণা করি যে, মুসলমান এবং হিন্দু দুজনই সঠিক কথা বলেছে। একইভাবে যখন চিনাকী ভট্টাচার্য বলে এই সরকার নাস্তিকদের পক্ষের সরকার তখনও আমি তার সাথে একমত হই, আবার যখন আবুল আলা নন্দবী বলে এই সরকার নাস্তিকদের খুনি তখনও আমি তার সাথে একমত হই। যখন চিনাকী ভট্টাচার্য বলে, বিএনপি-জামাত হচ্ছে ইসলামী মূল্যবোধের ধারক ও বাহক এবং এর বিপরীতে যখন আবুল আলা নন্দবী বলে, বিএনপি-জামাত হচ্ছে প্রগতিশীলতার ধারক ও বাহক তখন আমি দুজনের সাথেই একমত হই। এবং খোঁজ নিলে দেখবেন, এই যে প্রচন্ড পরস্পরবিরোধী বক্তব্যদাতা চিনাকী ভট্টাচার্য এবং আবুল আলা নন্দবী, এরা দুজনই কিন্তু একে অপরের পরম বন্ধু।
আমি দুনিয়ার সবগুলো ধর্মের বিশ্বাসীদের সাথে এই বিষয়ে একমত যে, তার ধর্ম বাদে সবগুলো ভুয়া। বাংলাদেশের প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলের প্রায় সকল ব্যক্তিই ইসলামী চেতনার ধারক। বামপন্থীদের আগে অসাম্প্রদায়িকতার ধারক মনে করতাম, কিন্তু এখন আর তা মনে করি না। বামপন্থীরা নিজেদের অজান্তেই চীনের পাল্লায় পড়ে ‘ইসলামের সেবায়েত’ হয়ে গেছে। তাঁরা অন্ধভাবে কমিউনিস্ট পার্টি অফ চায়নাকে বিশ্বাস করেছে। আর কমিউনিস্ট পার্টি অফ চায়না আসলেই যে দক্ষিণ এশিয়াতে অসাম্প্রদায়িকতা দেখতে চায় না তাও আমরা জানি।
বায়াসনেস থেকে বেরিয়ে গিয়ে সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলতে হবে, নাস্তিককে নাস্তিক আর জঙ্গিকে জঙ্গি বলতে হবে। কেবল দাড়িটুপিওয়ালা মোল্লারাই জঙ্গি আর দাড়িটুপি ছাড়া মোল্লারা নাস্তিক না এমন ধারণা থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। কেবল আব্দুল কাদের আব্দুল গফুররাই জঙ্গি কিন্তু ভট্টাচার্য, রায়, ব্যানার্জিরা জঙ্গি না এমন ধারণা থেকেও বেরিয়ে যেতে হবে।
Leave a Reply