লিখেছেন : বিধুভূষণ দাস বিধান
বাংলায় কখন থেকে শক্তির আদি বলে খ্যাত কালী পূজার প্রচলন শুরু হয় সে সম্পর্কে স্পষ্ট কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না ইতিহাসে। খ্রিষ্টীয় ৭ম শতাব্দী থেকে বাংলায় কিছু কিছু অঞ্চলে কালী পূজার প্রমাণ মিলে। নবদ্বীপের তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে বাংলায় কালীমূর্তি ও কালীপূজার প্রবর্তক মনে করা হয়। মহাভারতে কাল রাত্রি বা কালী নামে এক দেবীর কথা আছে যিনি মৃত যোদ্ধা ও পশুদের আত্মাকে বহন করেছিলেন।
অনার্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবীদের। তারা পূজিত হতেন আদ্যাশক্তির প্রতীক রূপে। মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের গঠন ও উর্বর শক্তির সমন্বয়ের কথা বিবেচনায় এনে অনার্য সমাজে গড়ে উঠে মাতৃ প্রধান দেবী সংস্কৃতির ধারনা। ভারতে অবশ্য মাতৃরূপে দেবী ধারনা নতুন কিছু নয়। ২২,০০০ বছর পূর্বে ভারতে প্যালিওলিথিক জন গোষ্ঠি থেকেই দেবী পূজা প্রচলিত হওয়ার প্রমাণ মিলেছে ইতিহাসে। সিন্ধু সভ্যতায় এসে তা আরো গ্রহণযোগ্য, আধুনিক ও বিস্তৃত হয়। মাতৃপ্রধান পরিবারের আর্দশকে সামনে রেখে দেবী বিশ্বাসে গড়ে উঠে শাক্ত সম্প্রদায়। এই মত অনুসারে দেবী হলেন শক্তির রূপ, তিনি পরব্রহ্ম। শাক্ত মতে কালী বিশ্বসৃষ্টির আদি কারণ। অনান্য দেব দেবী মানুষের মঙ্গলার্থে তাঁর বিভিন্ন রূপে প্রকাশ মাত্র।
প্রধান শাক্ত ধর্মগ্রন্থ দেবীভাগবত পুরাণে দেবীই সকল শক্তির উৎস। তিনিই সব। শাক্তরা ব্রহ্মের শক্তিরূপে দেবীর পূজা করেন। এ সব দেবীর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হল- চন্ডি বা কালী। তবে পুরুষতন্ত্রে বিশ্বাসী আর্যদের আগমনের পর অনার্য এই সব দেবীদের একক প্রভাব আস্তে আস্তে কমে গিয়ে আর্য পুরুষ দেবতাদের সাথে সমন্বিত হয়ে পাশাপাশি অবস্থান নেয় এইসব দেবী। তাই শাক্তমতে ব্রহ্মের পুরুষ রূপটি দেখা যায় শিবের। শাক্তধর্মের মূলতত্ত্ব অনুসারে- “শক্তির সহিত মিলিত হইলে শিব সৃষ্টিক্ষম হন; না হইলে তাঁহার আলোড়ন তুলিবার ক্ষমতা পর্যন্ত নাই।”
শাক্তদের এই দেবী শক্তির একক নেতৃত্ব পুরুষ তান্ত্রিক শৈব সম্প্রদায়ের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব হয়নি কখনো। তাই শৈব ও শাক্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম দিকে আপন আপন বিশ্বাসে অটল থাকায় ছিল প্রচন্ড বিরোধ। পরে একটা গ্রহণযোগ্য সমাধানে অর্থাৎ সমন্বয়ে এসে স্থির হতে সময় লেগে যায় বেশ কিছু দিন। শিবের সাথে সম্পর্ক সমন্বয় করে কেউ হয়েছেন শিবের স্ত্রী, কেউ বা কন্যা।
শাক্তদের কাছে প্রধান দেবী হলেন কালী। তাঁর গায়ের রং মিশ কালো চিত্রিত করার পেছনে অনার্য দেবী হওয়াকে দায়ী করেন ইতিহাসবিদেরা। কারণ অনার্যদের দেহের রং ছিল কালো। বাংলায় কালীর বিভিন্ন রূপের কথা বলা আছে। যেমন – দক্ষিণাকালী, শ্মশানকালী, ভদ্রকালী, রক্ষাকালী, গুহ্যকালী, মহাকালী, চামুণ্ডা ইত্যাদি। কালী সাধকদের মধ্যে রামকৃষ্ণ পরমহংস, রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য, রাজা রামকৃষ্ণ বেশ খ্যাতি লাভ করেছেন বাঙ্গালী হিন্দু সমাজে। কিছুকাল আগেও কালী প্রভাবের অবস্থান এতটাই শক্তিশালী ছিল ভিন্নধর্মী হয়েও কাজী নজরুল ইসলামের উপর পড়েছিল তার রেশ যা আমরা দেখি তাঁর লেখা শ্যামাসংগীতে। তাঁর অনেক কবিতাতে পড়েছে কালী প্রভাবের ছাপ।
তবুও এই সব দেব-দেবীদের ঐতিহাসিক কোন ভিত্তি নেই। সবই আমাদের পূর্ব পুরুষদের মস্তিষ্ক প্রসূত কল্পনা মাত্র।
Leave a Reply