লং-উইকএন্ড ছিল–মানে শনি রবি সোম–তিনদিন বন্ধ। শনি-রবি তো এমনিতেই বন্ধ। সোমবার, মানে অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহের সোমবার কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার/আগমন স্মরণে পালন করা হয় কলম্বাস দিবস।
কলম্বাস এলো, তারপর আমেরিকার ইতিহাস পাল্টে যেতে শুরু করল–আমেরিকার আদিবাসীদের মেরে-কেটে শেষ করে… ইদানিং অবশ্য ওরকম একটা মানুষের নামে একটা দিবস পালন করা নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে, তাই শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো করে এই দিনে কিছু স্টেটে একই সাথে ‘আদিবাসী দিবস’ও পালন করা হচ্ছে। যদিও এখন আমেরিকায় আদিবাসী নেই বললেই চলে, যারা আছে–সবাই ‘ইমিগ্রান্ট’।
আফ্রিকা থেকে মানুষের যে ‘জার্নি’ শুরু হয়েছিল, তাতে আমরা সবাই ইমিগ্রান্ট। আর যেহেতু সবাই ইমিগ্রান্ট, তাই ইমিগ্রান্টরা ঠিক করেছে ইমিগ্রান্ট হওয়াটা লিগ্যাল। যেমন ধরেন আমরা সবাই হাগু করি, তাই হাগু করা নিয়ে আমরা কখনো ট্রল করি না, কারণ হাগু থুক্কু থুুথু উপরের দিকে ছুঁড়লে নিজেদের মুখেই এসে পড়ে কি না। তো শুধু আমেরিকাতেই নয়, সারা বিশ্বেই ইমিগ্রান্টদের মধ্যে এখন অন্যতম বড় সমস্যা হলো বর্ণবাদ–সাদা আর কালা। ভারতে আর্য-অনার্য প্রসঙ্গ আনলে কিছু আজাইরা ক্যাচাল হয়, তাই ভারতের বিষয়ে কথা তুললে আর্য-অনার্য শব্দ ব্যবহার না করে ফর্সা-শ্যামলা ব্যবহার করাটা অধিক নিরাপদ।
ভারতে যারা আদিবাসী, তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো সাঁওতালরা। এরাই ভারতে কৃষিবিপ্লবের সূচনা করে। যারা এখনো জীবিকা হিসাবে কৃষিকেই আঁকড়ে ধরে আছে, তারা মূলত ওই সাঁওতালদেরই বংশধর–ভিন্ন জাতের সাথে মিশে আরো অনেক জাতের সৃষ্টি হয়েছে। সাঁওতালরা শ্যামলা-কালো।
ভারতে ফর্সারা কবে কোথায় থেকে এলো, বা কোথা থেকে উৎপত্তি হলো, সেই তর্কে না গিয়ে বৈদিক যুগে গেলে দেখা যায়–তারা তখনো শিকারী-যাযাবর, ফসল ফলাতে শেখেনি। এই গোষ্ঠীর রাজাদের দেখা যায় রামায়ণের যুগে এসে হালচাষ করতে। এই রাজবংশীয়রা মহাভারতের যুগে যাদেরকে নিচু চোখে দেখত, ব্যাসদেবকে দেখা যায় সেই নিচু জাতের একজন হিসেবে।
কৃষ্ণ ঐতিহাসিক চরিত্র কি না, সেটা তর্কের বিষয়ে হলেও ব্যাসদেব ঐতিহাসিক–এটা বোধহয় বলা অনেকটাই নিরাপদ। অনেকেই বলেন যে কৃষ্ণ ইচ্ছে করলেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ থামাতে পারতেন, কিন্তু সেটা করেননি, বা বলা যায় ব্যাসদেব সেটা চাননি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আসলেই হয়ছিল কি না, সেটাও তর্কের বিষয়, তবে এটা তো নিশ্চির যে ব্যাসদেব অন্তত মনে মনে চেয়েছিলেন বলেই ওরকম কাহিনী নিয়ে মহাভারত লিখেছিলেন–ভারতবর্ষের ওই ফর্সা রাজারা একে অন্যের সাথে মারামারি করে ধ্বংস হয়ে যাক। মহাভারত ঐতিহাসিক নয়–এমনটা ধরে নিলেও ব্যাসদেবের মহাভারতের এই চাওয়াটা তো ঐতিহাসিক। কিন্তু তিনি ওরকম কেন চাইবেন বা কল্পনা করবেন?
শোনা যায়, এখন যারা আধুনিক মানুষ–এই প্রজাতির আরো কিছু ভাইবোন ছিল, যারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে, কিংবা এই আধুনিক মানুষেরাই তাদেরকে শেষ করে দিয়েছে। অর্থাত এই যে আধুনিক ভাইয়ে-ভাইয়ে মারামারি-কাটাকাটি সম্পর্ক–এগুলা মূলত আমাদের রক্তেই প্রবাহমান! আমাদের রক্ত যতবার ভাগ হয়েছে, নতুন জাতি হয়েছে, ততই ওই হানাহানি বেড়েছে; আমাদের রক্তে শত্রুতার ব্যাপারটা ততই বেশি হয়েছে, হচ্ছে। সামনে আরো হবে। সভ্যতার খাতিরে আমরা সেসব জিনিস লুকিয়ে রাখি–এই লুকিয়ে রাখার ব্যাপারটাই মূলত আমাদের কাছে ‘সভ্যতা’।
এই লুকানোর ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে গেছে যে আমরা বউ-মেয়েদের সর্বাঙ্গ মুড়িয়ে লুকিয়ে রাখাটাকেও এক ধরনের সভ্যতা মনে করি। আবার বউ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আফ্রিকানদের ‘চয়েজ’ কেমন, ঠিক জানি না, তবে ভারত উপমহাদেশে কালো ছেলেরা ফর্সা মেয়ে যে বেশি খোঁজে–এ বিষয়ে বোধহয় তেমন দ্বিমত করবেন না কেউ। কিন্তু এর ব্যাখ্যা কী? লজ্জা উপন্যাসের সেই হিন্দু নায়ক বোনের উপর হওয়া অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে যেমন একজন মুসলিম মেয়েকে ‘টার্গেট’ করেছিল, সেরকম কিছু?
ফর্সাদের ব্যাপারে এ দেশের কালোদের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখের ছিল না কোনোকালেই। সেই বৈদিক যুগ, রামায়ণ-মহাভারতের যুগ, ব্রাহ্মণদের কূটকাচালি থেকে শুরু করে তুর্কি-আরব-ইংরেজদের আগমন–ফর্সারা এ দেশের কালোদের জীবন কখনোই সুস্থির থাকতে দেয়নি। ‘জাতের মেয়ে কালো ভালো’–এই প্রবাদ, কিংবা ‘নারীর মধ্যে বরণ কালো, পুরুষ মধ্যে রসিক ভালো’–এই ধরনের গান তো রাজনৈতিক নয়, বরং স্থানীয়দের হাজারো বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতার বোবা কান্না…
যাক সে কথা, আমরা সবাই যখন ইমিগ্রান্ট, তখন আজকাল আমরা সভ্যরা আমাদের মাইগ্রেশনকে এই বলে জাস্টিফাই করে থাকি–জীবনের প্রয়োজনেই আমরা ‘মাইগ্রেট’ করি–বিষয়টা স্বাভাবিক, তবে যেখানে যাই, সেখানে যেন থাকতেই যাই–স্থানীয়দের সংস্কৃতি-জীবনযাত্রাকে সম্মান করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব হলে তবেই যেন থাকি, আর সাম্রাজ্যবাদকে যেন খারাপ চোখে দেখি। এই হিসাবে আর্য-তুর্কি-আরব-মোঘল–এদের মধ্যে যারা থাকতে এসেছিল–তারা ভালো, শুধু ইংরেজরা খারাপ, কারণ তারা সাম্রাজ্য বিস্তার করতে এসেছিল। তো সবাই মিলেমিশে থাকেন, এবং বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের সাথে অমুসলিমদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান কেমনে সম্ভব–সেটা নিয়ে ভাবতে থাকেন।
[বি.দ্র. আমি কালো, তাই ফর্সা সুন্দরীরা ইনবক্সে এলে মাইন্ড করবো না…]
কৃতজ্ঞতা : উইকিপিডিয়া
Leave a Reply