ব্রিটেনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ হচ্ছে ইসলামি সংগঠন
যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামি শিক্ষার্থী সংগঠনগুলোর বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
গত সপ্তাহে যুক্তরাজ্যের লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংগঠন ইসলামিক সোসাইটির বিরুদ্ধে লিঙ্গবৈষম্যের অভিযোগ ওঠার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্ত শুরু করেছে।
ব্রিটেনের ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে আজ সোমবার বলা হয়, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক সোসাইটি আয়োজিত এক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে নারী ও পুরুষদের আলাদা-আলাদা জায়গায় বসানো হয়। বক্তৃতার শিরোনাম ছিল ‘ঈশ্বর কি আছেন?’ এতে আমন্ত্রিত অতিথি বক্তা ছিলেন হামজা জর্জিজস। ‘ইসলামিক সচেতনতা সপ্তাহ’ উদযাপন উপলক্ষে সংগঠনটি ওই বক্তৃতার আয়োজন করে।
এদিকে, ব্রিটেনের ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন (ইউসিএল) একই ধরনের অভিযোগ তদন্তের পর তাদের ক্যাম্পাসে একটি ইসলামি সংগঠনের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের এক বিতর্ক অনুষ্ঠানে নারী ও পুরুষকে আলাদা-আলাদা স্থানে বসতে বাধ্য করেন সংগঠকেরা। ওই অনুষ্ঠানেও প্রধান আলোচক ছিলেন জর্জিজস।
১৮২৬ সালে ধর্মনিরপেক্ষ নীতিকে ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউসিএল। শুরু থেকে ধম-বর্ণ-লিঙ্গনির্বিশেষে সবার ভর্তি নিশ্চিত করা হয় এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে সমপরিমাণ নারী ও পুরুষকে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হতো।
গত মাসে লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে শতাধিক শিক্ষার্থী উপস্থিত হয়েছিল। ‘দ্য গার্ডিয়ান’ বলেছে, তাদের কাছে অনুষ্ঠানের প্রবেশপথে টাঙানো একটি নোটিশের ছবি আছে। সেটিতে নারী ও পুরুষদের পৃথক হয়ে বসার জন্য নির্দেশ লেখা ছিল।
ওই ইসলামিক সোসাইটির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে: ‘আমাদের সব অনুষ্ঠানে নারী ও পুরুষদের আলাদা করে বসার রীতি কঠোরভাবে মেনে চলা হয়।’ সংগঠনটির সঙ্গে ‘গার্ডিয়ান’ কথা বলতে চাওয়ার পর সংগঠনটি তার ওয়েবসাইট থেকে বক্তব্যটি সরিয়ে ফেলে।
লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মুখপাত্র বলেছেন, সবার জন্য উন্মুক্ত এমন কোনো অনুষ্ঠানে বিভেদের নীতিকে তাঁরা কখনোই অনুমোদন করেন না। সংগঠনটি অনুষ্ঠানস্থলের প্রবেশপথ পৃথক করেছিল কি না, তা তদন্ত করে দেখা হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় এটা নিশ্চিত করছে যে, এমনটি আর হতে দেওয়া হবে না।
ওই মুখপাত্র আরও বলেন, ‘(হলে) নিজের পছন্দের জায়গায় বসার যে অধিকার অংশগ্রহণকারীদের আছে, তার ওপর বিশ্ববিদ্যালয় কখনো হস্তক্ষেপ করবে না। যদি কেউ তার ধর্মবিশ্বাসের কারণে আলাদা হয়ে বসতে চায়, তবে তারা স্বাধীনভাবে তা করতে পারবে। একই ভাবে, যদি কেউ পৃথক হয়ে বসতে না চায়, তবে সে অধিকার তাদের আছে।’
মুখপাত্রটি আরও বলেন, ‘আমাদের জানামতে, কাউকে কোনো নির্দিষ্ট আসনে বসতে বলা হয়নি। তবে জোরাজুরির কোনো প্রমাণ যদি মেলে, তবে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থী ইউনিয়ন তা অবশ্যই তদন্ত করে দেখবে।’
তবে লেস্টারের এক শিক্ষার্থী ‘গার্ডিয়ান’কে বলেন, তাঁর ধারণা, ইসলামিক সংগঠনটিতে লিঙ্গবৈষম্য বহুল প্রচলিত বিষয়।
মানবাধিকারকর্মী পিটার ট্যাটশেল বলেন, ‘বসার ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য সম-অধিকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থী ইউনিয়নের বৈষম্যবিরোধী নীতির সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। লিঙ্গীয় কারণে শিক্ষার্থী ও নিয়োগপ্রাপ্তদের বৈষম্যনীতির শিকার হওয়া উচিত নয়।’
ট্যাটশেল বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় হলো শিক্ষা, সহনশীলতা, সংস্কারমুক্ত চিন্তা ও মানবাধিকারচর্চার জায়গা। এটা খুবই দুঃখজনক যে, কিছু ইসলামিক শিক্ষার্থী সংঘ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রচ্ছন্ন মদদে নারী শিক্ষার্থীদের পৃথক স্থানে বসতে বাধ্য করছে। অথচ এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের চুপ করে বসে থাকার কথা নয়। ক্যাম্পাস সব শিক্ষার্থীর জন্য নিরাপদ ও বৈষম্যহীন করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে ভূমিকা রাখার কথা, তা তারা করছে না।’
লেস্টারের শিক্ষার্থী ইউনিয়নের কর্মকর্তা ড্যান ফ্ল্যাট বলেন, ‘ছাত্র ইউনিয়ন কাউকে বৈষম্যমূলক আচরণ করতে বাধ্য করার নীতিতে বিশ্বাস করে না। ইউনিয়নের নীতি অনুসারে অন্যান্য শিক্ষার্থী সংঘের কার্যক্রম চালানোতে কোনো অসুবিধা নেই।’
শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা স্টুডেন্ট রাইটসের সদস্য রুপার্ট সুটন দাবি করেন, দেশজুড়ে বিভিন্ন ইসলামিক ছাত্র সংগঠন বৈষম্যমূলক আচরণের চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে।
রুপার্ট লিখেছেন, যাঁরা এসব নিয়ম (বৈষম্যমূলক আচরণ) আরোপ করেন, তাঁরা বলেন এগুলো ঐচ্ছিক। এসব নিয়ম কার্যকর থাকলে একজন নারীকে যেভাবে এগুলো মেনে নিতে ও মেনে চলতে হয়, তা তাঁকে পরাধীন করে দেয়।
এ ধরনের আরেকটি ঘটনা সম্প্রতি খবরের কাগজগুলোর শিরোনাম হয়েছে। ইউনিভার্সিটি কলেজে লন্ডনের অধ্যাপক লরেন্স ক্রাউস এক ইসলামিক সংঘের অনুষ্ঠানে নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদ জানিয়ে হল থেকে বেরিয়ে আসেন। তবে পরে আয়োজকেরা ওই নীতি পরিত্যাগের প্রতিশ্রুতি দিলে তিনি অনুষ্ঠানে ফিরে যান।
সম্প্রতি ইস্ট লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ও একটি ইসলামি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছে। এটির বিরুদ্ধে লিঙ্গীয় বৈষম্যমূলক আচরণের মধ্য দিয়ে সভা পরিচালনার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছিল।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স এসব বৈষম্যমূলক নীতিকে ‘লিঙ্গীয় বর্ণবাদ’ বলে অভিহিত করেছেন।
http://www.prothom-alo.com/detail/date/2013-04-14/news/345005
Leave a Reply