লিখেছেন: আসিফ মহিউদ্দীন
ধরুন আপনি একজন পাকিস্তানী গুপ্তচর, বাঙলাদেশে এসেছেন নাশকতা ঘটাতে। বাঙলাদেশের কোন স্থাপনা, কোন জনসভায় বোমা মেরে মানুষ হত্যার হুকুম হয়েছে আপনার পাকি উর্ধতন কর্তৃপক্ষ থেকে। আপনি বোমা মারলেন, মানুষ মারলেন, কিন্তু পালাতে পারলেন না। ধরা পরে গেলেন বাঙলাদেশের পুলিশের হাতে।
স্বাভাবিকভাবেই, তখন পাকিস্তান সরকার এবং পাকিস্তানী দুতাবাস এর দায় দায়িত্ব অস্বীকার করবে। তারা বলবে, ইহা পাকিস্তানের মত মহান রাষ্ট্রের নীতি নহে। ঘটনার দায় পুরোপুরি অস্বীকার করে তারা নানান হাস্যকর কথাবার্তা বলবে। যেমন, পাকিস্তান কখনও নিরীহ মানুষ হত্যার সাথে সম্পৃক্ত নয়, পাকিস্তান শান্তিকামী দেশ। ইহা কিছু বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীর কাজ, অথবা ভারত-আমেরিকা বা ইসরাইলের কাজ, অথবা বাঙলাদেশিরা নিজেরাই নিজেদের উপরে বোমা মেরে পাকিস্তানীদের দুর্নাম করতে চায়। পাকিস্তানের সাথে এই হত্যাকান্ডের কোন সম্পর্ক নাই। তারা এই হত্যাকান্ডের নিন্দা জানায়। (মুখে এসব বললেও তারা মনে মনে ব্যাপক আনন্দিত হবে, সেটা বলাই বাহুল্য)
সেই পাকি এজেন্টটাও এটা জানে যে, সে ধরা পরে গেলে পাক সরকার তার পক্ষে কথা বলবে না। এই ধরণের কাজ যারা করে, তারা এসব জেনে বুঝেই করে।
এবারে আরেকটি ঘটনা বলি। ধরুন কোন এক ইসলামী মৌলবাদী বাঙলাদেশের নববর্ষে রমনার বটমূলে বোমা হামলা করলো, বা মন্দির পুড়িয়ে মূর্তি ভেঙ্গে হিন্দু হত্যা করলো, বা হিন্দু মৌলবাদী মসজিদের নামাজ পরার সময় বোমা মেরে বেশ কিছু মানুষকে হত্যা করলো। এরপরের ঘটনা কি হবে?
এরপরে যা হবে, তা হচ্ছে, দেশের গন্যমান্য ইসলামিস্টরা বা হিন্দুবাদীরা, জামাত ইসলামী থেকে শুরু করে হিজবুত তাহরির এবং অন্যান্য ইসলামী দলগুলো/মডারেট ধার্মিকগন বা হিন্দুবাদী গলা বেধে গান শুরু করবে, ইহা ছহি ইসলাম/হিন্দুবাদ নহে। ইসলামের/হিন্দু ধর্মের সাথে এর কোন সম্পর্ক নাই। ইসলাম/হিন্দুধর্ম শান্তির ধর্ম। ইহা কিছু বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীর কাজ। ভারত-আমেরিকা বা ইসরাইলের চক্রান্ত, অথবা যারা মারা গেছে তারা নিজেরাই নিজেদের উপরে বোমা মেরে ইসলামিস্ট/হিন্দুবাদদের দুর্নাম করতে চায়। ইসলাম/হিন্দুধর্মের সাথে এই হত্যাকান্ডের কোন সম্পর্ক নাই। তারা এই হত্যাকান্ডের নিন্দা জানায়। (মুখে এসব বললেও তারা মনে মনে ব্যাপক আনন্দিত হবে, সেটা বলাই বাহুল্য। আমি নিজেই দেখেছি ৯-১১ এর ঘটনার পরে অনেক ওয়াজে এই ঘটনার জন্য শুকরিয়া আদায় করা হয়েছে, নিরীহ আমেরিকানদের মৃত্যুতে অনেক মুসলিমই উল্লাস করেছেন প্রকাশ্যে!)
যেই জঙ্গিটি এই হামলা চালিয়েছে, সে নিজেও জানে, সে ধরা পরে গেলে তার সাহায্যে কেউই এগিয়ে আসবে না। কেউই দায় দায়িত্ব স্বিকার করবে না, কেউই তাকে সমর্থন দেবে না। কিন্তু তাকে তৈরি কিন্তু করেছিল তার উপরের পর্যায়ের নেতারাই, তার ভেতরে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা কিন্তু ঢুকিয়ে দিয়েছিল তার মাদ্রাসা-তার কোরান-তার রামায়ন মহাভারত-তার ধর্মই। কিন্তু ধরা পরে গেলে কেউ আর পাশে থাকছে না তার।
দুইটি ঘটনার মধ্যে কোন মিল খুঁজে পাচ্ছেন?
হ্যা, পাকিস্তান মৌলবাদী রাষ্ট্র বলেই পাকিস্তানী এজেন্টরা সারাদুনিয়া জুড়ে নাশকতা চালায়। ইসরাইল একটি দুষিত রাষ্ট্র বলেই ইসরাইলের এজেন্টরা সারাদুনিয়া ব্যাপি হত্যাযজ্ঞ চালায়। শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। তারা যতই বলুক, ইহা ছহি পাকিস্তান নহে বা ইহা ছহি ইসরাইল নহে, একটু ভাবলেই মুল ব্যাপারটা ধরা যায়।
তেমনি ইসলাম-হিন্দু-খ্রীষ্টান-ইহুদী ধর্মগুলো যতই শাক দিয়ে মাছ ঢাকুক, তাদের আর ঢেকে ঢুকে, মুখ উলটে অস্বীকার করার উপায় নেই। স্ব স্ব ধর্মের মুমিনগন চোখ কান নাক মুখ বুজে বালুতে উট পাখির মত মাথা গুজেই থাকবে।
রমনার বটমূলে বোমা হামলার সেই ভয়ংকর ঘটনা আজও মনে পরে। ঢাকার রাস্তায় লক্ষ বাঙালির ঢল দেখে, তাদের প্রানের উচ্ছাস দেখে বুঝলাম, যতই আগ্রাসন আসুক, যতই আরবীয়-হিন্দী-ইংরেজী সংস্কৃতি আমাদের ভেতরে ঢুকে পরুক, বাঙালি তার মুল সুর ঠিকই খুঁজে নেয়।
মৌলবাদী বোমা হামলা দিয়ে আতংক সৃষ্টি করে, পত্রপত্রিকা-টিভি চ্যানেল-ব্লগে-ফেসবুকে মৌলবাদী আহাম্মকগুলা শত প্রচারণা চালিয়েও, ইসলামের দোহাই দিয়ে, পরকালের ভয় দেখিয়ে, বেহেশতের লোভ দেখিয়ে, কুফর বেদাত শিরকের দুর্গন্ধযুক্ত কথাবার্তা বলেও বাঙালিকে তাদের প্রানের পয়লা বৈশাখ থেকে বিরত রাখতে পারে নি। হিন্দু মুসলিমদের ভেতরে ধর্মের দেয়াল তুলে দিয়ে আমাদের আলাদা করতে পারেনি। আমরা ঠিকই আমাদের হাত খুঁজে নিয়ে শক্ত করে ধরেছি। ধরার সময় জিজ্ঞেস করিনি, সে হিন্দু নাকি মুসলিম।
বাঙালি তার অসাম্প্রদায়িক চেতনা ঠিকই টিকিয়ে রেখেছে, এবং রাখবে। মৌলবাদ, আগ্রাসন, সাম্রাজ্যবাদ যত শক্তিশালীই হোক, জয় হবে রবীন্দ্রনাথের, জয় হবে লালনের, জয় হবে নজরুলের। সর্বপরি জয় হবে ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাঙালির।
Leave a Reply