লিখেছেন সমকোণী বৃত্ত
প্রসঙ্গ: মৃত্যু ও স্বাধীন ইচ্ছা
ধার্মিকদের মুখে যে-কথা হরহামেশাই খইয়ের মত ফুটে ওঠে, তা হলো “সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা।” ধার্মিকদের স্ব স্ব ঈশ্বরও প্রীত হন “সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা” এই কথা শুনে। মাঝখানে ঝামেলাটা বাধালো মানুষ এসে। মানুষেরও নাকি স্বাধীন ইচ্ছা আছে! সেও নিজের ইচ্ছা মত কাজ করতে পারে। আসুন, একটু পরখ করে দেখি, মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার কথা বলাটা কতটা খাঁটি।
মৃত্যু যে ঈশ্বরের ইচ্ছায় হয়, এটা কোন ধার্মিক না জানে! কিন্তু কথা হলো, ঈশ্বর কীভাবে মানুষের মৃত্যু ঘটান? অনেক ধর্মের মতে, মৃত্যু কার্যকর করার জন্য ঈশ্বর কাউকে নিয়োজিত রেখেছেন। যদিও ঈশ্বর বললেই হয়ে যায়, তারপরও সাহায্যকারীর প্রয়োজন পড়ে। যেমন, আজরাঈল, যম ইত্যাদি। তা ঈশ্বর মৃত্যু কার্যকর করার জন্য প্রেরিত দূতকে কখন পাঠান?
ক) জীবন নেওয়ার জন্যই কি সেই বিশেষ দূত এসে মৃতপ্রায় অবস্থার সৃষ্টি করে?
খ) মানুষের মৃতপ্রায় হলে তখন সেই দূত এসে জীবন নিয়ে যায়?
ধরে নিই, উত্তর ‘ক’, এবং মনে করি, রহিম করিমকে খুন করলো। এক্ষেত্রে রহিমকে দোষ দেওয়া যাবে না। আর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করাও ঠিক হবে না। কেননা, ঈশ্বরই করিমের জীবন নেওয়ার জন্য এরূপ অবস্থার অবতারণা করেছেন। রহিমের খুন করতে হলো করিমকে, ঈশ্বরের জীবন নেওয়ার প্রক্রিয়া সচল রাখতে। তাছাড়া ঈশ্বর নাকি জীবন নেওয়ার জন্য সময়ও নির্ধারণ করে রেখেছেন। কেউ সেই সময় এগিয়েও আনতে পারবে না, পেছাতেও পারবে না। অর্থাৎ ঈশ্বর রহিমকে ব্যবহার করেছে অন্যের জীবন নেওয়ার জন্য। তাহলে তার স্বাধীন ইচ্ছাটা থাকলো কোথায়?
এবার ধরে নিই, উত্তর ‘খ’ অর্থাৎ মানুষ যখন মৃতপ্রায় হয়ে যায়, তখন ঈশ্বর দূত পাঠিয়ে জীবন নিয়ে নেন। এটা হলে, ঈশ্বর জীবন নেওয়ার মালিক নন, বরং তিনি মানুষের মুখাপেক্ষী। এক্ষেত্রে জীবন নেওয়ার মালিক হলো রহিম। সে ইচ্ছা করেছে, তাই করিমকে হত্যা করতে পেরেছে। এখানে আরো একটা সমস্যা বেধে যায়। তা হলো: এই ক্ষেত্রে রহিম হয়ে যায় জীবন নেওয়ার মালিক, এমনকি হুকুমদাতাও। এমনকি রহিমের ইচ্ছাতেই ঈশ্বরকে কাজও করতে হয়।
যেমন, রহিম করিমের মস্তক ছেদন করলো, শিরা-উপশিরা সব কেটে দিলো করিমকে মেরে ফেলার ইচ্ছায়। তো এখন ঈশ্বর মহাশয় যেখানেই থাকুক, যেই কাজেই ব্যস্ত থাকুক আর তাঁর দূত যে-কাজেই থাকুন না কেন, করিমের জীবন নেওয়ার জন্য দূতকে করিমের কাছে পাঠাতেই হবে সে ঈশ্বরের। করিমের মৃত্যুর সময় হোক আর না হোক, (ধার্মিকদের মতে ঈশ্বর আগেই নাকি মৃত্যুর সময় নির্ধারণ করে রেখেছেন, সেই সময়)।
যদি বলেন, সেই নির্ধারিত সময় এসেছে বলেই রহিম করিমকে হত্যা করেছে। এই ক্ষেত্রে তো তাহলে রহিম সেই নির্ধারিত সময়ের হয়েই কাজ করছে, তার স্বাধীন ইচ্ছা তো তাহলে কাজ করছে না। সুতরাং “ক” কিংবা “খ” যেটাই বেছে নেন, ঝামেলা দুটোতেই আছে। তাছাড়া ঈশ্বরের কাজ ঝামেলা ছাড়া তেমন একটা দেখাও যায় না…
আরো একটা কথা: ঈশ্বর জীবন নেন, ভাল কথা। তিনি কি এমন ভাবে জীবন নিয়েছেন কখনো, যাতে প্রমাণ হয় যে, জীবন ঈশ্বরই নেন। একটু বিস্তারিত বলি… মানুষ (অন্যান্য প্রাণীও) সাধারণত মারা যায় বিভিন্ন রোগে কিংবা দুর্ঘটনায়। তো বিজ্ঞান শরীরকে যেভাবে ব্যাখ্যা করে, তাতে রোগ কিংবা দুর্ঘটনায় কোনো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা শরীরবৃত্তীয় কাজ ব্যাহত হলে মস্তিষ্ক যখন স্থায়ীভাবে কাজ করা বন্ধ করে, তাকেই মৃত্যু বলে। কিন্তু ঈশ্বরের মৃত্যুর পদ্ধতিতে তো ভিন্ন কিছুই দেখা যায় না, যদিও বলা হয়ে থাকে ভিন্ন। যেমন আত্মা বা রুহ্ থাকে, যা জীবনের মূলে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো ঈশ্বরকেই দেখলাম না, যিনি শরীরের ক্ষতি না করে আত্মা বা রুহ্ বের করেই মানুষকে মেরে ফেলতে পেরেছেন।
ধর্মমতে যেহেতু আত্মা বা রুহ্ হলো জীবনের মূল, তাই একে বের করেই নিলেই কাজ শেষ হয়ে যায়। এখানে শরীরকে আহত করার দরকার আছে কি? আরেকটু পরিষ্কার করে বলি: ঈশ্বরেরও ক্ষমতা নেই কোনো সুস্থ মানুষকে মারার। মারার আগে সেই মানুষকে অসুস্থ করে নিতে হয়। এখন বলতে পারেন, এমন অনেক মানুষকেই দেখেছি, যারা একদম সুস্থ ছিলো, কিন্তু হঠাৎ করে মারা গেছে। এর উত্তর হলো: আপনার জানায় ভুল আছে। ময়নাতদন্ত করলে দেখতে পারবেন, সুস্থ থাকলেও মৃত্যুর আগে সে অসুস্থ হয়েছিলো। হয়ত হার্ট অ্যাটাক বা এরকম কিছু হয়েছিলো। তবে এটা একেবারে শতভাগ নিশ্চিত যে, সেই ব্যক্তি সুস্থভাবে মারা যায়নি।
অনেকেই বলতে পারেন, রুহ্ বা আত্মা চলে যাওয়ার ফলেই শারীরিক ক্ষতি হয়। এর উত্তর: প্রথমত, শরীরের সাথে আত্মার বা রুহের যোগসূত্র নেই। তাই তা দেহ থেকে বের হলে শরীরের ক্ষতি হওয়ার কথা না। দ্বিতীয়ত, যদি মেনেও নিই যে, রুহ্ বা আত্মা বের হওয়ার কারনেই শরীর ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবুও শেষ রক্ষা হয় না। কারণ রুহ্ বা আত্মা চলে যাওয়ার অর্থাৎ মৃত্যু ঘটার পর শরীর ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, বরং শরীর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলেই মৃত্যু ঘটে এবং মৃত্যুর পরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া চলমান থাকে।
ঈশ্বর তাঁর দলবল রেখেছেন জীবন নেওয়ার জন্য, অথচ তিনিই বলেন, জীবন রুহ্ বা আত্মার ফল। তাহলে সে রুহ্ বা আত্মা শরীর থেকে সরিয়ে নিলেই হয়। তা করেন না, করতে পারবেনও না। তাই ঈশ্বরকে চ্যালেঞ্জ জানাই, পারলে আপনার রুহ বা আত্মা তত্ত্বের প্রমাণ দিন। জানি, পারবেন না, কখনই পারবেন না শুধু রুহ বা আত্মা সরিয়েই জীবনের অবসান ঘটাতে। আপনাকে অবশ্যই শরীরের মুখাপেক্ষী হতে হবে। তাই এখানে জোর করে ঈশ্বরের আগমন ঘটানো নিতান্তই হাস্যকর। মৃত্যু শরীরবৃত্তীয় কাজ। এখানে ঈশ্বরের কোনোই প্রভাব নেই। তবে হে ঈশ্বর! আপনি এ কেমন ঈশ্বর, যিনি মানুষের মুখাপেক্ষী? তবে কেন আপনার কাছে আমি মাথা নোয়াবো?
Leave a Reply