ধর্ম ও দর্শন নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতে গিয়েই একটা প্রশ্ন আবার নতুন করে মাথায় আসছে। আস্তিক আগে, নাকি নাস্তিক আগে?
তার আগে কেউ বলেন তো, নিরাকার ঈশ্বরের ধারণাটা সর্বপ্রথম কোথায়, কারা, কিভাবে চালু করেছিল? (রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁর “ভোলগা থেকে গঙ্গা”তে যে ইঙ্গিতটা দিয়েছেন, সেটাই কি সত্যি?)
মাধবাচার্য্যের “সর্বদর্শন সংগ্রহের” প্রথম অধ্যায়েই চার্বাক দর্শন সম্পর্কে বলা হয়েছে। সেটা পড়ে আবারো লজ্জায় পড়ে গেছি। এরকম লজ্জায় আগেও একবার পড়েছিলাম তসলিমা নাসরিনের লেখা পড়ে। ব্লগে-ফেসবুকে যা বলতে চাই বা বলি তা অনেক আগেই তনা লিখে গেছেন। আর এই চার্বাকদের দু-চারতে যুক্তি যা এখনো প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে পাওয়া যায়, তা দেখে লজ্জায় মরে যাই–আমরা আর কী যুক্তিতর্ক করি! তারা সেই তখনকার দিনের বাঘা বাঘা বেদ রচিয়তা ব্রাহ্মণদের যেভাবে ঘোল খাওয়াতো, তাতে এদের কাছে তো আমরা কিছুই না! আবার রাজা-ক্ষমতাবানরা ছিল ঐসব ব্রাহ্মণদের পক্ষে, চার্বাকদের বিপক্ষে। তারপরও তারা কোথায়ও ভয়তে মাথা নুইয়েছে, এমনটি শোনা যায় না। তাদেরকে মেরে ফেলা হয়েছে, তাদের বই-পুস্তক ধ্বংস করা হয়েছে, কিন্তু চিন্তা-চেতনা এখনো বেঁচে আছে…শুধু বলেন–“প্রমাণ দাও!”–দেখবেন সেই রক্ত নিজ শরীরেই আবার ঢেউ তুলছে।
চার্বাকরা কিভাবে যুক্তি উপস্থাপন করতেন, বেদরে কিভাবে উড়িয়ে দিয়েছেন, তার কিছু দৃষ্টান্ত দেখুন চার্বাক দর্শন নিয়ে মাধবাচার্য্যের লেখাতে:
– “প্রত্যক্ষমাত্র প্রমাণ, অনুমানাদি প্রমাণ নহে।”
– “কতিপয় প্রতারক ধূর্ত্তেরা বেদের সৃষ্টি করিয়া, তাহাতে স্বর্গ নরকাদি নানা প্রকার অলৌকিক পদার্থ প্রদর্শন করত, সকলকে অন্ধ করিয়া রাখিয়াছে এবং তাহারা স্বয়ং ঐ সকল বেদবিধির অনুষ্ঠান করত জনসমাজের প্রবৃত্তি জন্মাইয়াছে এবং রাজাদিগকে যাগাদিতে প্রবৃত্ত করিয়া তাঁহাদিগের নিকট হইতে বিপুল অর্থ লাভ করিয়া নিজ নিজ পরিজন প্রতিপালন করিয়াছে।”
– “অগ্নিহোত্র, বেদাধ্যয়ন, দণ্ডধারণ, ভস্মগুণ্ঠন এই সমস্ত বুদ্ধিপৌরুষহীন ব্যক্তিদিগের উপজীবিকা মাত্র।”
– “বেদে লিখিত আছে পুত্রেষ্টিযাগ করিলে পুত্র জন্মে, কারীরীযাগ করিলে বৃষ্টি হয়, শ্যেনযাগ করিলে শত্রুনাশ হয়। তদনুসারে অনেকেই ঐ সকল কর্ম্মের অনুষ্ঠান করিতেছেন, কিন্তু কোন ফলই দৃষ্ট হইতেছে না।”
– ” এক স্থানে বিধি আছে সূর্য্যোদয় হইলে অগ্নিহোত্র যাগ করিবে, অন্য স্থানে কহিতেছে, সূর্য্যোদয়ে হোম করিবেক না, যে ব্যক্তি সূর্য্যোদয়ে হোম করে, তাহার প্রদত্ত আহুতি রাক্ষসের ভোগ্য হয়। এইরূপে বেদে অনেক বাক্যের পরস্পর বিরোধ দৃষ্ট হইয়া থাকে এবং উন্মত্তপ্রলাপের ন্যায় বারম্বার এক কথার উল্লেখও দেখিতে পাওয়া যায়। যখন এই সমস্ত দোষ দেখা যাইতেছে, তখন কি প্রকারে বেদের প্রামাণ্য স্বীকার করা যাইতে পারে। অতএব স্বর্গ, অপবর্গ ও পারলৌকিক আত্মা সমস্তই মিথ্যা এবং ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়াদির ব্রহ্মচর্য্যাদি চারি আশ্রমের কর্ত্তব্য কর্ম্ম সফলও নিষ্ফল। ফলতঃ অগ্নিহোত্র প্রভৃতি কর্ম্ম সকল অবোধ অক্ষম ব্যক্তিদিগের জীবনোপায়মাত্র।”
– “ধূর্ত্তেরা ইহাও করিয়া থেকে যে জ্যোতিষ্টোমাদি যজ্ঞে যে জীবের ছেদন হইয়া থাকে সে স্বর্গলোকে গমন করে। যদি ঐ ধূর্ত্তদিগের ইহাতে সম্পূর্ণ বিশ্বাস থাকে, তবে তাহারা যজ্ঞেতে আপন আপন পিতা মাতা প্রভৃতির মস্তকচ্ছেদন না করে কেন?”
– “শ্রাদ্ধ করিলে যদি মৃত ব্যক্তির তৃপ্তি হয়, তবে কোন ব্যক্তি বিদেশে গমন করিলে তাহাকে পাথেয় দিবার প্রয়োজন কি। বাটীতে তাহার উদ্দেশে কোন ব্রাহ্মণকে ভোজন করাইলেই তাহার তৃপ্তি জন্মিতে পারে।”
– “অপিচ, এই স্থানে শ্রাদ্ধ করিলে যদি স্বর্গস্থিত ব্যক্তির তৃপ্তি হয়, তবে অঙ্গনে শ্রাদ্ধ করিলে প্রাসাদোপরিস্থিত ব্যক্তির তৃপ্তি না হয় কেন?”
– “যাহাতে কিঞ্চিদুচ্চস্থিতের তৃপ্তি হয় না, তদ্দ্বারা অত্যুচ্চ স্বর্গস্থিত ব্যক্তির তৃপ্তি কি প্রকারে সম্ভব হইতে পারে?”
– “ভণ্ড, ধূর্ত্ত ও রাক্ষস এই ত্রিবিধ লোক একত্র হইয়া বেদ রচনা করিয়াছে। অশ্বমেধ যজ্ঞে যজমানপত্নী অশ্বশিশ্ন গ্রহণ করিবে ইত্যাদি বিষয় সকল ভণ্ডের রচিত। স্বর্গ নরকাদি বিষয় সকল ধূর্ত্তের প্রণীত। এবং যে সকল অংশে মদ্য মাংশ নিবেদনাদির বিধি আছে, তাহা নিশাচরের কল্পিত। অতএব বেদশাস্ত্র মিথ্যা, বুদ্ধিমান লোকেরা কোন মতেই তাহাতে বিশ্বাস করেন না।”
(সূত্রঃ http://www.ebanglalibrary.com/religious/?p=1842)
প্রথম প্রশ্নে ফিরে যাই। এত সহজে এর উত্তর টেনে সিদ্ধান্তে আসা হয়তো বোকামী হবে, তবুও আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, এই চার্বাক অর্থাৎ বাস্তববাদীরা বরাবরই ছিল। যখন আদিকালের সমাজে গাছপালা-পশুপাখি-পাহাড়-নদী বা বিভিন্ন সম্মানীয় বা সমাজে যাদের অবদান আছে, তাদেরকে পূজার মাধ্যমে সম্মান দেয়ার মধ্যে হয়তো একটা বাস্তব যুক্তি ছিল। চার্বাকরা এগুলা কি চোখে দেখত, সেটা জানা গেছে কিনা জানি না। তবে যখনই সুবিধাবাদী ভণ্ড ব্রাহ্মণেরা বেদ লিখে এই নিরাকার ঈশ্বরের নামে ভুজুং-ভাজুং শুরু করেছে, তখন চার্বাকরা প্রতিবাদ করেছে, তাদের ভণ্ডামি ধরিয়ে দিয়েছে। আর সেই থেকেই মনে হয় আস্তিক-নাস্তিক ক্যাচালের সূত্রপাত। এই ভণ্ডামি তখনকার দিনের এইসব লোকেরাও বুঝেছিল, কিন্তু এখনকার শিক্ষিত মানুষেরাও এটা বোঝে না, এইটাই চরম আক্ষেপের বিষয়!
Leave a Reply