নারায়ণ ব্রহ্মারে কইল, “দেবগণ ও অসুরগণ একত্র হইয়া জলধিমন্থন করিতে আরম্ভ করুন। মন্থন করিলে সমুদ্র হইতে অমৃত উত্থিত হইবে।”
নারায়ণের আদেশ পাইয়া ব্রহ্মা দেবতাদের কইল, “হে সুরগণ! তোমরা সমুদ্র-মন্থন কর, কিন্তু বহুবিধ ওষধি এবং রত্নসমূহ পাইয়াও মন্থনে ক্ষান্ত হইও না। ধৈর্য্যাবলম্বনপূর্বক অনবরতই মন্থন করিতে থাকিবে, তাহা হইলেই তোমাদের অমৃতলাভ হইবে, সন্দেহ নাই।”
কিন্তু অমৃত কী? অমৃত হইলো সেই জিনিস যা খাইলে অমর হওয়া যায়। অর্থাৎ এই ঘটনার আগে কেউ অমর ছিল না। দেবতারাও না। তাই সবার আগে দেবতারা অমর হওয়ার বাসনায় সমুদ্রমন্থনে নাইমা গেল।
মন্থন কী জিনিস? হিন্দুপাড়ার মহিলাদের অনেকেই হয়তো দেখেছেন দুধ ভর্তি বড় পাতিলের মধ্যে একটা বাঁশের দণ্ড ঢুকিয়ে দড়ি দিয়ে দুই দিক থেকে টেনে মাখন বানায়। এই পদ্ধতিটাই হইন মন্থন। [চিত্র ১ দ্রষ্টব্য]
যা হোক, পানি-সম্পদ-মন্ত্রী রাজী না হওয়াতে ডাকা হইল অবতার কচ্ছপকে। সে রাজী হইল। [এত উপকারী অবতার কচ্ছপকে হিন্দুরা কেন খায়, সেইটা আজো বুঝতে পারি নাই।] কিন্তু এত্ত বড় বড় দেবতা-ব্যাঙগানিকরা থাকতেও এই পর্বতরে বেড় দেয়ার জন্য দড়ি বানাইতে পারল না। তাই ডাকা হইলো বাসুকি-নাগরে। তারপর লেজের দিকে দেবতারা আর অন্যদিকে অসুররা ধরে টানাটানি কইরা শুরু হইলে সিন্ধু-সমুদ্র-মন্থন। (সিন্ধু–খেয়াল কৈরা।) [চিত্র ২ দ্রষ্টব্য]
![[চিত্র ২]](https://chutrapata.files.wordpress.com/2015/11/manthan.jpg)
কূর্ম্মপৃষ্ঠে গিরিবর করিয়া স্থাপন।
বাসুকি-নাগের দড়ি করিল যোজন।।
পুচ্ছেতে ধরি দেব, মুখে দৈত্যগণ।
আরম্ভ করিল সিন্ধু করিতে মন্থন।।
পর্বতের সাথে বাসুকি নাগের ঘষায় ঘষায় যে নিশ্বাস বের হল, সেই নিশ্বাস থিকা ধোয়ার সৃষ্টি হইল। সেই ধোয়া থিকা আকাশে মেঘের সৃষ্টি হইল (আহা, কী বিজ্ঞান)। সেই মেঘ থিকা বৃষ্টিও হইল। ভাগ্যিস কয় নাই বৃষ্টি থিকা পানির বদলে মধু ঝইরা পড়ছে।
যা হোক, সমুদ্রমন্থনের ফলে অনেক ধনরত্ন লাভ হইল। ইন্দ্র তার ঐরাবত নামক হাতি পাইল। কিন্তু এত কিছু পাইয়াও দেবতা-অসুরদের থামাথামির নাম নাই, লোভে পইড়া মন্থন চালাইয়া যাইতে লাগল। ওদিকে পানি বেশী ঘোলা হইয়া কাঁদা হইয়া যায় দেইখা পানি-সম্পদ মন্ত্রী ভাবলেন এতো ভারী যন্ত্রণা। ড্রেন দিয়া খনন কইরা তার অধীনের সমস্ত ধনসম্পদই তো লইয়া যাইতেছে।
পাত্র-মিত্রগণ ল’য়ে করিল বিচার।
কিরূপে মথন হৈতে পাইব নিস্তার।।
মন্ত্রী বলে, উপায় শুনহ মোর বাণী।
শরণ লইবে চল যথা চক্রপাণি।।
মন্ত্রী তার সচিবদের নিয়া পরামর্শ কইরা ঠিক করল সর্বাধিকারী বিষ্ণুরে বুঝাইয়া কইতে হইবে। কি কইতে হইবে? এইবার সমুদ্রমন্থনের আসল কাহিনী–
তবে সেটা শুরু করার আগে টগরের একটা কথার সূত্র ধরে ব্যাপারটা একটু ভিন্ন ভাবে দেখি-
রামায়ণ নিয়া আলোচনার এক প্রসঙ্গ টগর কহিয়াছিলেন- “দেবতা নিজেকে খর্ব করিয়া মানুষ করেন নাই, মানুষই নিজগুণে দেবতা হইয়া উঠিয়াছেন।” এমন সহজ-সরল ভাবে বোধ হয় আর ব্যাখ্যা করা যায় না। হাজার হাজার বছরে ধরে চলে আসা এই মানব সভ্যতার ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষের অনেক অবদানের ফলেই মানুষ আজকে এই পর্যায়ে আসতে পেরেছে। তাদেরকে আমরা মহামানব বা মহাপুরুষ বলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, কেউ বা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি, কেউবা তাদেরকে দেব-দেবীরূপে পৌত্তলিক মতে পূজাও করি; যদ্যপি যদাচার।
বিশ্বের নানান জাতির নানান সময়ে এমন দেবদেবীর কথা আমরা জানতে পারি। এও জানি যে একেকজন দেবতার একেকদিকে বিশেষত্ব ছিল বা আছে। যেমন হিন্দুধর্মের ইন্দ্রর কথা ধরি। বৈদিক যুগে একটা সভ্যতার একটা ধারাকে সে একসময় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে বলে ধর্মগ্রন্থ থেকে জানা যায়। “ইন্দ্রত্ব লাভ” বলে একটা কথা আছে। তাতে মনে করা হয়, ইন্দ্র কোন একক দেবতা নয়; এটা একটা পদ, স্বর্গের রাজা, দেবতাদের রাজা। সভ্যতার ইতিহাসে হয়তো একাধিক ব্যক্তি এই পদটি অলংকৃত করেছিল। আর বিভিন্ন সময় এর অনেক আকাম-কুকাম করার ফলে এই পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, শাস্তি হয়েছে। আবার নিজের গুণে সে এই পদ ফিরে পেয়েছে। আমাদের এরশাদ চাচ্চু কিংবা ধরেন আমেরিকা প্রেসিডেণ্টের কথা (ক্লিনটন)। মিল পান কিছু? ঠিক এভাবেই হয়তো আগুনটা যার আয়ত্বে ছিল বেশি তাকে অগ্নিদেব, পানির দেবতাকে বরুণদেব, বাতাসের দেবতাকে পবনদেব…এভাবে একটা রাজকার্য্য পরিচালনা করতে একটা দেশে যতপ্রকার মন্ত্রীর দরকার হয়, হিন্দুধর্মে দেবতাদের সেরকম অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। এই পুরোটাই হয়তো একটা মানবগোষ্ঠিকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিল।
এই হিসাবে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিবকে তুলনা করেন ভারতের সোনিয়া গান্ধীর সাথে। কোন পদে নাই, কিন্তু সব পদেই আছে।
সমুদ্রমন্থনের আসল কাহিনীতে ফিরে যাওয়া যাক- পানি-সম্পদ-মন্ত্রী বরুণদেব তার সচিবদের নিয়া কী পরামর্শ করল? দেখুন–
জনমিল যেই কন্যা কমল-কাননে।
তাহা দিয়া পূজা কর দেব-নারায়ণে।।
পূর্ব্বে নাম ছিল তাঁর লক্ষ্মী হরিপ্রিয়া।
মুনি-শাপ-ভ্রষ্ট হৈয়া জন্মিল আসিয়া।।
তাহার কারণে সিন্ধু হইল মথন।
নিবারণ হবে, লক্ষ্মী পেলে নারায়ণ।।
সেই আদি এবং অকৃত্রিম রাজনৈতিক চাল- বুইড়ারে সুন্দরী মাইয়া সাপ্লাই… শলা-পরামর্শ হইল- সুন্দরী মাইয়া দিয়া নারায়ণের পূজা করতে হবে। আর কইতে হইবে পূর্বে এই সুন্দরীই লক্ষ্মী ছিল। মুনির অভিশাপে সে আবার নতুন কইরা জন্ম নিছে। তাইলে আর কেউ সন্দেহ করবে না!
অবাক করার বিষয় হইল- এই বরুণদেবরে পরামর্শটাও দিয়েছিল আরেক বুইড়া খবিশ ব্রহ্মা। কেননা এই ব্রহ্মারেই বিষ্ণু আকার-ইঙ্গিতে কইয়া দেবতাদের দিয়া সমুদ্রমন্থন করাইতে বলেছিল। বিষ্ণুর মনের আসল কথা ব্রহ্মা ঠিকই বুঝেছিল। এটা পরের দিকে আরো পরিষ্কার হবে।
তার আগে এখানে আরেকটা বিষয়- কথা হইতেছে সমুদ্র-মন্থন নিয়া, সেখানে সিন্ধুর কথা আইলো কিভাবে? ধরেন, তখন এই গ্রুপটি উত্তর-পূর্ব থেকে আইসা সিন্ধুর তীরে বসতি গড়েছে। আগে কখনো সমুদ্র না দেখা জাতি এই সিন্ধুরেই তার বিশালতা দেখে সমুদ্র হিসাবে বর্ণনা করছে। আর আগে বরুণদেব সম্পর্কে যে কথা বলা হইছে- বরুণদেবের ক্ষেত্র থিকা যে সূর্যের উদয় হয়–ধরে নেন এই ইনফো যখন আবিষ্কার হইছিল তখন এরা সিন্ধুনদের পশ্চিম তীরে অবস্থান করছিল। তাই সূর্যকে পূর্বদিকে বরুণদেব অর্থাৎ সমুদ্রের ভিতর থিকা উঠতে দেখত।
আবার ফিরে যাই সমুদ্র তথা সিন্ধু মন্থনে-
ব্রহ্মার উপদেশ পাইয়া মন্ত্রী মহাশয় একটা সুন্দরী মাইয়া আর তার দলবল নিয়া উপস্থিত হইল বিষ্ণুর কাছে। অনেক ভুজুং-ভাজুং-পামপত্তি-তেল মালিশ কইরা বিষ্ণুরে তেলাইয়া ফেলিল। লগে আরো কইল- অন্যান্যদের যেমন একেকটা ডিপার্টমেন্ট দিছেন, তেমনি আমারে দিছেন পানি-সম্পদ-মন্ত্রনালয়। কিন্তু এইভাবে সবাই লুটপাত কইরা নিয়া গেলে তো আমি নিঃস্ব হমু-
তোমার সৃজন দেব এ তিন ভুবন।
স্থানে স্থানে সকলেতে তোমা নিয়োজন।।
ইন্দ্রে স্বর্গ দিলা, যমে সংযমনী-পুর।
কুবেরে কৈলাস দিলা ধনের ঠাকুর।।
জল মধ্যে আমারে করিয়া দিলা স্থিতি।
তব আজ্ঞায় চিরকাল করি যে বসতি।।
কোন দোষে দোষী নহি তব পদ্মপাদে।
তবে কেন আমি এত পড়িনু প্রমাদে।।
তেলে তেলিত হইয়া নারায়ণ পানি-সম্পদ-মন্ত্রীরে আশ্বাস দিয়া কইলো–
আশ্বাসি বলেন হরি, শুন জলেশ্বর।
না করহ চিন্তা কিছু, না করিহ ডর।।
সাথে আরো কইলো (এইটাই আসল কাহিনী কিন্তু) –
দুর্ব্বাসার শাপে লক্ষ্মী ছাড়ি নিজ স্থল।
তিনপুর ত্যজি প্রবেশিলা সিন্ধু-জল।।
এতক্ষণে বুইড়া ভাম, কহিলা বিষাদে- অর্থাৎ নারায়ণের সুন্দরী বউ ঝগড়া কইরা সিন্ধুতে ডুইবা মরছে। তারে খুঁইজা আনার জন্যই ডুবুরি নামাইতে হবে সিন্ধুতে। ঘটনা আসলে তাই-
হতলক্ষ্মী হয়ে কষ্ট পায় সর্ব্বজন।
সমুদ্র মথিল সবে তাহার কারণ।।
এখন ব্যাপারটা আরো প্রাকটিক্যাল ভাবে দেখতে পারেন- হয় ডুবুরি নামাইছিল, নয়তো বড় বড় কচ্ছপের খোলের সাথে দড়ি বাইন্ধা পানি সেচের কাজ চলছিল। পর্বত কাইটা আইনা হয়তো একদিকে বাঁধ দেয়া হইছিল। আর যে ধনসম্পদ পাওয়া গেছিল, হয়তো তারও আগের কোন সভ্যতা ডুবে বা ভেঙে বিলিন হয়ে গিয়েছিল সেইখানের সিন্ধু নদে।
যা হোক, সুন্দরী পাইয়া লুইচ্চা হারামজাদা দেখেন আবার কেমনে লোল ফেলায়-
লক্ষ্মী যদি মিলিল, মথনে কিবা কাজ।
বিশেষ তোমার ক্লেশ হৈল জলরাজ।।
অর্থাৎ নতুন সুন্দরী মাইয়াটারে পছন্দ হইছে। তাই আগেরটারে আর খুঁইজা কাম নাই। আবার একটু লজ্জা লজ্জাও পাইতেছে, তাই বরুণদেবরে সান্ত্বনাও দিতেছে- হ, তোমার কষ্ট হইল, কিছু মনে কইরো না! আর দেখেন মন্ত্রী তার দলবল নিয়া আগে থিকাই ঠিক কইরা রাখছিল এই নতুন সুন্দরী মাইয়াটারেই লক্ষ্মীর নতুন জন্ম বইলা চালাই দিবে। অর্থাৎ লক্ষ্মীও “রানী”র মত একটা পদ বা পদবী।
অমৃত না বাল! শালা লুইচ্চা হারামজাদা, বউ ভাগছে বা মরছে বইলা রাতে ঘুম হয় না, কইলেই পারছ; হুদাহুদি অমৃতের লোভ দেখাস কেন!
শ্রীবরুণ হাত মারে, জন্ম হয় মুনি।
ধমাধম গান্জা টানে, কহ অক্ষুণি।।
Leave a Reply