লিখেছেন: Hasibul Hasan Sharod
শহিদমিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ নিয়ে কম ফতোয়া শুনিনি। ছোটবেলা থেকে শুনেছি এই কাজটা হচ্ছে হিন্দুদের মূর্তিপূজার মতো; কারণ ফুল দেয়ার ব্যাপারটা আছে এতে। ফতোয়াবাজরা যুক্তি দেখায়, একুশে ফেব্রুয়ারিতে একটা মিলাদ দাও, ফুল দেবা কেন? ফুল দেয় হিন্দুরা। হিন্দুরা যেমন মূর্তিতে ফুল দেয়, তুমি যদি সেই কায়দায় শহিদমিনারে ফুল দেও, তা পূজা হইবে, তা শেরেক হইবে; মিনার বানানোও এমনকি মূর্তি বানাবার শামিল।
আজও হয়তো তাদের হৃদয়ে প্রোথিত সেই অন্ধ গোঁড়ামো অনেকেরই যায়নি। অনেকের আবার গেছেও। যাদের গেছে তাদের এককালের সেই ধর্মবিশ্বাসেরই একটা অঙ্গহানী হলো এর দ্বারা। ধর্মের কারণেই তো তাদের বিশ্বাস ছিল এটা হিন্দুপূজার শামিল, শেরেক হতে পারে! ইসলামি হাদিস-কোরান গবেষণা করে তারা সেই ফতোয়া ঝেড়েছে অর্ধশতাব্দী ধরে। এরপর কেউ কেউ সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে। মাদরাশাগুলোয়, আমার জানামতে, কোনো শহিদমিনার স্থাপন করা হয় না, কলাগাছের শহিদমিনারও না। কারণ তা আবার হয়ে যায় অনেকটাই লক্ষ্মীপূজার ভাবাপন্ন। ফুল দেয়া তো দূরের কথা; ফুল দিলে তো পুরা পূজাই হয়ে গেল আরকি! তাই দেশের সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শহিদদিবস পালিত হলেও মাদরাশাগুলো এসব পালনের বাইরে। মাদরাশায় পড়া বিপুল সংখ্যক ছেলেমেয়ে একে এখনো মনে করে বেদায়াত। ফুল নিয়েই এদের যত গণ্ডগোল।
ওদিকে হাদিসে আছে, নবি বলেছিলেন ‘দু-টাকা হাতে থাকলে এক টাকার ফুল কিনে নিয়ো।’ সে-ফুল দিয়ে কী করা হবে? মন প্রফুল্ল করা হবে। পূজা দেয়া হবে না নিশ্চয়ই। শুভেচ্ছা-ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ কি সে-ফুল দেয়া যেতে পারে কাউকে? কোনো স্মৃতিস্তম্ভ, বধ্যভূমি, কবরে? ছোটবেলা থেকে তো শুনে আসছি, না, দেয়া যেতে পারে না। আবার ইদানিং শোনা যাচ্ছে এসব সেরেফ ফতোয়া। আমাদের কয়েকটা বড় রাজাকার আছে, যারা নাকি ইসলামিক চিন্তাবিদ, যেমন গোলাম আজম, সাইদি, এরা এই বিষয়ে এত বছরে কী বলেছে? জাকির নায়েক সহ ইসলামিক টিভি ও পিস টিভির চিন্তাবিদেরা কী বলেছেন?
বাঙালি একটি সঙ্কটাবৃত জাতি, যারা অনেক বিষয় নিয়েই দ্বিধা, ত্রিধা, বহুধাবিভক্ত; এমনকি ভাষাআন্দোলনে এবং মুক্তিযুদ্ধে মৃতদেরকে শহিদ বলা যাবে কিনা তা নিয়েও। বাঙালিদের কেউ কেউ যায় শহিদমিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করতে, আবার কেউ কেউ একই জিনিশকে মনে করে মূর্তিপূজা। কেউ কেউ যায় সাংবিধানিক গণতন্ত্রের বদলে জঙ্গিঅভ্যুত্থান ঘটাতে, আর কেউ কেউ আবার বলে গণতন্ত্রই সহি। কেউ কেউ যায় বাংলাদেশি নারীদের অধিকার আদায়ে, আবার কেউ কেউ নারীনীতির বিরুদ্ধেই হরতাল ঘোষণা করে। কেউ কেউ এখানে রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদেরকে মনে করে ইসলামের বন্ধু, আবার অনেক মুসলমানই এদেরকে মনে করে খাঁটি শয়তান। কেউ কেউ মনে করছে গানবাজনা-অভিনয়-কাব্য-চিত্র-কনডম ইত্যাদি অসংখ্য জিনিশ বেদিনি ও ইসলামঅসম্মত; আবার তারাই দিব্যি গান শুনছে, অভিনয় করছে, সিনেমানাটক-নাচ-ব্লুফিল্ম দেখছে, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-শেখ মুজিবদের ছবি দেয়ালে টাঙাচ্ছে।
তো বাঙালি জাতির সবাই নানা রকম বিপরীতমুখী চিন্তাকেই হয়তো মনে করছে ইসলামসম্মত, তাই না? তেমনি এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষাদিবসটিকেও। শহিদমিনারে ফুল দেয়া ইসলামের দৃষ্টিতে কতটুকু জায়েজ? সবচেয়ে কষ্টকর হলো, বাংলা একটি হিন্দুয়ালি ভাষা, এ-কথাও বাঙালিকে শুনতে হয়েছে, এদেশি কিছু গোঁড়া মুসলমান পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরশাসকদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে দাবি করেছিল বাংলা ভাষা লেখা হবে আরবি হরফে। আরবি হরফের সম্মান রাখেনি বাঙালি, তারা বাংলা লিখছে বাংলার নিজস্ব হরফেই। বাঙালি বরং দিন দিন সৃ্ষ্টি করে চলেছে আরবি-ইংরেজিসহ যতটা সম্ভব বিদেশি শব্দের প্রতিশব্দ, পারিভাষিক শব্দ। উর্দুশিক্ষা একসময় ছিল বাঙালি ছাত্রদের পাঠ্য, এখন নেই। মাদরাশাগুলোও মানুষের মন থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলছে দিন দিন, আরবি শিক্ষার চেয়ে ইংরেজি শিক্ষা মান পাচ্ছে বেশি (যদিও এটা আমরা চাইনি, আমরা চেয়েছিলাম বাংলা ভাষামাধ্যমের শিক্ষাব্যবস্থা, যা হয়নি)।
যাহোক, বাংলা ভাষা শুধু একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসমষ্টির মুখের ভাষাই নয়, বাংলা একটি অগ্রযাত্রার নাম, একটি অভিযানের নাম, একটি উত্তরণশীলতার নাম। এটি দিন দিন উৎকর্ষ লাভ করছে, সম্ভাবনামণ্ডিত হয়ে উঠছে, বাংলাভাষীদের মমত্ব ও সচেতন পাঠাভ্যাস লাভ করছে। আগে এই ভূখণ্ডের মানুষ যতটা মাতৃভাষাবোধসম্পন্ন ছিল, তারচেয়ে এখন তারা বেশি। আগে মাতৃভাষা বাংলায় যেটুকু শুদ্ধতা ছিল, চর্চা ও শিক্ষার উৎসাহ ছিল লোকেদের মনে, সেটা দিন দিন বেড়ে চলেছে। ফেসবুক-ব্লগজগতে প্রগতিমনাদের প্রধানতম অস্ত্র ভাষা। একদিন এই বাংলার জন্যে বাংলায় লাশ পড়েছে, বহু আন্দোলন হয়েছে, আজও সেই সংগ্রাম চলছে। পাকিস্তানের মতো অচেতন গণ্ডারদের বিরুদ্ধে প্রথম ব্যবহৃত হয় বাংলা, তারপর থেকে ধর্মীয় আগাছা উৎপাটনের কাছে লাগে বাংলা, এখনো সেই অভিযান চলমান। তবে আমরা লড়াই করে এগোচ্ছি দিন দিন; আর যারা বাংলার শত্রু, বাংলা ভাষার শত্রু, যারা শহিদমিনারের শত্রু, যারা কেন্দ্রীয় শহিদমিনারে মানুষকে যেতে দেয়নি; তারা পরাজিত হচ্ছে দিন দিন। রক্ষণশীলরা দেখতে পাচ্ছে আগের মতো নেই আর আমরা, সব বদলাচ্ছে; বিশেষত ধর্মীয় মূল্যবোধ, নারীজীবন, শিক্ষাব্যবস্থা; ছড়িয়ে পড়ছে একুশের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এ দেখে তারা অস্থির, ভীত; তারা বারবার তাই প্রশংসা করে যাচ্ছে প্রাচীনতার, আগের সব কদর্যতাও সুন্দর ঠেকছে তাদের কাছে, তারা আক্ষেপ করে ফিরছে আগের সেই পরহেজগার, পর্দাপ্রথার, আরবি-আরবি উর্দু-উর্দু গন্ধমাখা দিনগুলো আর ফিরে পাবে না বলে।
Leave a Reply