সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বই কেনা‘ প্রবন্ধটি নিঃসন্দেহে বাংলা ভাষায় বইয়ের সেরা বিজ্ঞাপন, আর ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না’ কথাটা বই বিক্রির সেরা স্লোগান। সৈয়দ মুজতবা আলী মূল কথাটা অবশ্য এরকম–“বই কিনে কেউ তো কখনো দেউলে হয় নি।” বাঙালিদেরকে বই কেনা ও পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুললে এই প্রবন্ধের ভূমিকা অপরিসীম।
বাঙালিদেরকে বইমুখী করতে নিজের মন্তব্যের পাশাপাশি সৈয়দ মুজতবা আলী আরো অনেক গুণী ও জ্ঞানীজনের বই সম্পর্ক মন্তব্য এবং মজার গল্প উপস্থাপন করেছেন। আনাতোল ফ্রাঁস, বারট্রান্ড রাসেল, ওমর খৈয়াম, মার্ক টুয়েন, এক আরব পণ্ডিত, আঁদ্রে জিদ… এর মধ্যে ওমর খৈয়ামের উক্তিটি মনে হয় অনেকেই অনেকবার নিজেদের লেখায়ও ব্যবহার করেছেন–“রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত-যৌবনা-যদি তেমন বই হয়। “
তবে আমার সবচেয়ে মনে ধরেছিল বারট্রান্ড রাসেলের কথাটা–“সংসারে জ্বালা-যন্ত্রণা এড়াবার প্রধান উপায় হচ্ছে, মনের ভিতর আপন ভুবন সৃষ্টি করে নেওয়া এবং বিপদকালে তার ভিতর ডুব দেওয়া। যে যত বেশি ভুবন সৃষ্টি করতে পারে, যন্ত্রণা এড়াবার ক্ষমতা তার ততই বেশি হয়।”
রাসেলের কথার সূত্র ধরে সৈয়দ মুজতবা আলী নিজেই প্রশ্ন তুলেছিলেন–“কিন্তু প্রশ্ন, এই অসংখ্য ভুবন সৃষ্টি করি কি প্রকারে?” এর উত্তরও নিজেই দিয়েছেন–“বই পড়ে। দেশ ভ্ৰমণ করে। কিন্তু দেশ ভ্ৰমণ করার মত সামৰ্থ্য এবং স্বাস্থ্য সকলের থাকে না, কাজেই শেষ পর্যন্ত বাকি থাকে বই।”
২)
যারা অনলাইনে বেশি সময় কাটায়, প্রায় সময় ফেসবুকে থাকে, তাদের ব্যাপারে অনেকরে বলতে শোনা যায় যে, এই লোকগুলার বাস্তবে কোনো ‘লাইফ’ নাই–অর্থাৎ, এদের কোনো কাজকর্ম নাই, এদের ভালো চাকরি নাই, ভালো প্রেমিক-প্রেমিকা নাই, টাকা নাই, পয়সা নাই… আর এ কারণেই এরা অনলাইনে ভার্চুয়াল লাইফ, একটা অবাস্তব লাইফ, একটা লাল-নীল স্বপ্নের জগৎ নিয়ে পড়ে থাকে… শেষে এদেরকে একটা উপদেশ দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়–গেট এ লাইফ… মানে অফলাইনের বাস্তব জগৎ-সংসার নিয়ে পড়ে থাকতে বলে… অনলাইন-অফলাইন সব জায়গাতেই এই ধরনের উপদেশের মুখোমুখি প্রায়ই হই। কারণ সবাই দেখে আমি অনলাইনে পড়ে থাকি।
৩)
বারট্রান্ড রাসেলের কথাটায় যদি ফিরে যাই, ওসব বলে তিনি আমাদের কী শেখাতে চান? অবাস্তববাদী হতে বলছেন না? বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে স্বপ্নের জগতে চলে যেতে বলছেন না? সংসারে জ্বালা-যন্ত্রণা দেখলেই বইয়ের মধ্যে ডুব দেয়া… ডুব দেয়া মানে বইতে নানা ধরনের কাহিনী থাকে… নাটক-সিনেমা দেখতে দেখতে আমরা যেমন নিজেদেরকে নাটক-সিনেমার কোনো একটা চরিত্রের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে একটা দিবাস্বপ্নের জগতে ডুবে যাই, সেরকম বইয়ের কাহিনীতেও ডুবে যাওয়া…
এই ডুবে যাওয়ারই আরেকটা ভার্সন এই অনলাইন, ফেসবুক, ইনবক্স, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদি। বাস্তবে জানাশোনার বাইরেও একেবারেই জানাশোনা নেই এমন অনেকের সাথেও আমাদের আলাদা কিছু জগৎ সৃষ্টি হয়। সময়ে-অসময়ে একেকসময়ে আমরা এই একেকটা ‘অবাস্তব’ ‘রঙিন’ ‘স্বপ্নের’ জগতে ডুব দেই। (অবশ্য এটাও ঠিক যে, ওই অবাস্তব জগৎ যদি কারো কাছে ‘বাস্তব’ বলে মনে হতে শুরু করে, তখন হিতে বিপরীত হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে।)
৪)
বই এখন শুধু পড়ার জিনিস নয়। শোনারও জিনিস। অ্যামাজন থেকে শুরু করে আরো অনেকেই বইয়ের অডিও ভার্সন সহজলভ্য করে ফেলেছে। আমাদের দেশে এর ভিডিও ভার্সনও আছে–টিভি সিরিয়াল। যাদের বই পড়া বা শোনার সময় বা ধৈর্য্য নেই, তারা সংসারের কাজকর্মের ফাঁকে সময় বের করে টিভি-সিরিয়াল দেখে। এই সিরিয়াল দেখা গ্রুপটাকে নিয়ে অনেকেই অনেকভাবে ফান করে, কেউ কেউ এদের প্রতি বিরক্তও।
৫)
সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বই কেনা’র সূত্র ধরে বারট্রান্ড রাসেলের কথাটা আমলে নিলে মুখে বই গুঁজে পড়ে থাকা, অনলাইনে পড়ে থাকা, বা টিভি-সিরিয়াল নিয়ে পড়ে থাকা–কাউকেই সেভাবে দোষ দেয়া যায় না। এরা সবাই-ই কোনো না কোনো ভাবে সংসারের জ্বালা-যন্ত্রণা এড়াবার কিছু না কিছু উপায় বের করে ফেলেছে। শুধু টেকনলজির বদৌলতে মাধ্যম বদল হয়।
সংসারে জ্বালা-যন্ত্রণার পাশাপাশি সুখ-আনন্দও হয়তো আছে। তবে যারা আগেই বুঝে যায় যে, সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালো, তারা সংসার সর্বান্তকরণে এড়িয়ে থাকতেই চায়। পারা যায় কি না, জানি না… তবে যারা পারেন, তাদেরকে খুব হিংসা হয়।
Neel
আপনার লেখাগুলো ভালো লাগে । ভেতরে ভেতরে কেমন জানি নস্টালজিয়া কাজ করে । বই আসলেই অনেক ভালো বন্ধু । ইউরোপের বাস-ট্রেন-ট্রামগুলোত দেখা যায় বইপাগল মানুষগুলোকে বই পড়তে পড়তে যাচ্ছে নিজ নিজ গন্তব্যে । দেখলে মনে হয় এদের সাথে কিছু থাকুক আর নাই থাকুক অন্ততপক্ষে সঙ্গী হিসেবে বই আছে ।