আমাদের জানায় কৃষ্ণ প্রধাণত তিন প্রকার। ১) (তথাকথিত) ইতিহাস তথা পঞ্চমবেদ অর্থাৎ মহাভারতের কৃষ্ণ। ২) পুরাণ অর্থাৎ পৌরাণিক কৃষ্ণ, এবং ৩) বৈষ্ণব সাহিত্যের কৃষ্ণ। এর বাইরেও কৃষ্ণ থাকতে পারে, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। এখানে আরেকটা কথা বলে রাখা ভালো–পৌরাণিক কৃষ্ণ ও বৈষ্ণব কৃষ্ণ কোথাও কোথাও একাকার হয়ে যেতে পারে। এ কথা কেন বলছি, তা একটু ব্যাখ্যা করি।
লক্ষ্মণসেনের রাজসভার পঞ্চরত্নের একজন–কবি জয়দেব। বলা হয়–জয়দেবের গীতগোবিন্দ কাব্যের পদাবলীর সূত্র ধরেই বাংলা বৈষ্ণব পদাবলী তথা বৈষ্ণব সাহিত্যের সূত্রপাত। তবে গীতগোবিন্দের সূত্রপাত কীরূপে–অর্থাৎ গীতগোবিন্দের প্রথম শ্লোক–
মেঘৈর্ম্মেদুরমম্বরং বনভুবঃ শ্যামাস্তমালদ্রুমৈ–
নর্ক্তং ভীরুরয়ং ত্বমেব তদিমং রাধে গৃহং প্রাপয়।
ইত্থং নন্দনিদেশতশ্চলিতয়োঃ প্রত্যধ্বকুঞ্জদ্রুমং
রাধামাধবয়োর্জয়ন্তি যমুনাকূলে রহঃ কেলয়ঃ।।
অর্থাৎ– “হে রাধিকে! নভোমণ্ডল নিবিড় জলদজালে সমাবৃত হইয়া উঠিল, বনভূভাগও শ্যামল তমালতরুনিকরে অন্ধকারময়, শ্রীকৃষ্ণ অতীব ভয়শীল, নিশাভাগে একাকী গমনে সমর্থ হইবেন না; সুতরাং তুমি ইঁহাকে আপনার সমভিব্যাহারে লইয়া গমন কর।” নন্দকর্ত্তৃক এইরূপ অনুজ্ঞপ্ত হইয়া বৃষভানুনন্দিনী শ্রীমতী রাধাসতী হরি সমভিব্যাহারে পথপ্রাপ্তবর্ত্তী কুঞ্জতরুর অভিমুখে প্রস্থান করিলেন এবং কালিন্দীকূল সমুপস্থিত হইয়া বিরলে (মনসুখে) কেলি করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। তাঁহাদিগের সেই গুপ্তকেলি ভগবদ্ভক্তিপরায়ণ মহাত্মগণের হৃদয়-মন্দিরে প্রস্ফূরিত হইয়া জয়লাভ করুক।। (উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় অনূদিত)
আরেকটা অনুবাদ : আকাশ মেঘে আচ্ছন্ন, বনভূমি তমালতরুনিকরে শ্যামল, রাত্রিকাল, কৃষ্ণ ভীত। রাধা, তুমি ইহাকে লইয়া গৃহে যাও। এইরূপ নন্দনির্দেশে চলিত যমুনাকূলের প্রতি পথ-তরুকুঞ্জে শ্রীরাধা-মাধবের বিজনকেলি জয়যুক্ত হউক। (হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়)
এবার ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের কৃষ্ণজন্মখণ্ডের পঞ্চদশ অধ্যায়ের চতুর্থ ও পঞ্চম শ্লোক একটু দেখা যাক–
মেঘাবৃতং নভোদৃষ্ট্বা শ্যামলং কাননান্তকং।
ঝঞ্ঝাবাতং মেঘশোব্দং বহুশব্দঞ্চ দারুণং।৪।।
বৃষ্টিধারা মতিস্থূলাং কম্পমানাংশ্চ পাদপান্।
দৃষ্ট্বৈবং পতিতস্কন্ধান্নন্দো ভয় মবাপহ।৫।।
জয়দেবের গীতগোবিন্দের প্রথম শ্লোকের সাথে মিল পাচ্ছেন? আচ্ছা, অনুবাদটুকু দেখি–
…সেই নিবিড়ঘনঘটায় আচ্ছন্ন আকাশ মণ্ডল শ্যাম বর্ণ দৃষ্ট হইল, কাননের উন্মূলনে সক্ষম ঝঞ্জাবাত প্রবাহিত হইতে লাগিল, মেঘ নির্ঘোষ ও বহুবিধ সুদারুণ শব্দ শ্রুতিগোচত ও বিলক্ষণ বর্ষণ হইতে লাগিল এবং বৃক্ষ সমুদায় কম্পিত হইতে আরম্ভ হইল। এই সমস্ত ভীষণ ব্যাপার দর্শনে ব্রজরাজ নন্দ সেই বৃক্ষ স্কন্দ হইতে পতিত হইয়া ভয় প্রাপ্ত হইলেন…
গীতগোবিন্দের কাহিনীটা এখান থেকেই শুরু। এখন গীতগোবিন্দ আর ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের সময়, প্রেক্ষাপট ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গবেষণা করলে দেখতে পারেন, এই কৃষ্ণজন্মখণ্ডটি গীতগোবিন্দের পরবর্তীকালে বৈষ্ণবভাবাপন্ন সেনরাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত হয়ে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। তাতে স্বয়ং জয়দেবের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকাও থাকলেও থাকতে পারে।
তো এভাবে গীতগোবিন্দ আর পুরাণের সমন্বয়ে মূল-কাণ্ড এবং অতঃপরে বৈষ্ণব সাহিতের ডাল-পালা দিয়ে এক প্রকারের কৃষ্ণকে আমরা পাই–সেই সাথে পাই রাধাকে। (যদিও অনেক বৈষ্ণব ‘বেদে রাধার উল্লেখ আছে’–এমন হাস্যকর দাবী করেন। তারা ওই রাধা শব্দটির পিছে দৌড়াতে দৌড়াতে মহাভারতের কর্ণের পালিত মাতাকে যে রাধা হিসাবে উল্লেখ করেন নাই, সেটাই রক্ষে!) আর মহাভারতের কৃষ্ণকে যারা চিনেন, তারা জানেন–পুরাণ বা বৈষ্ণব পদাবলীর কৃষ্ণের সাথে মহাভারতের কৃষ্ণের কোনো মিল নেই। আর ‘রাধা-ছাড়া’ শুধু গোপীদের মধ্যে আরেক প্রকারের কৃষ্ণকে পাওয়া যায় ভাগবত পুরাণে।
এবার–
যদি মহাভারতের কৃষ্ণকে নিয়ে কথা ওঠে, তখন মহাভারতে ‘কৃষ্ণচরিত্র’ বর্ণনা বা ব্যাখার বেলার শুধু মহাভারতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। এই কৃষ্ণের যত তথ্য–দোষ-গুণ মহাভারতের মধ্যে পাওয়া যায়, তা সবই স্বীকার করতে হবে। আলাদা আলাদা ভাবে ভাগবতপুরাণের পৌরানিক কৃষ্ণ বা ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ এবং বৈষ্ণব সাহিত্যের কৃষ্ণের বেলাতেও তাই। আপাতত পাওয়া এই তিন টাইপের কৃষ্ণকে এক করে জগাখিচুড়ি বানালে শুধু জটিলতাই বাড়ে।
এর বাইরেও আরেক কৃষ্ণ থাকতে পারে বলছিলাম। এই কৃষ্ণ হলো বর্তমানে আমরা ইতিহাস বা সত্য বলতে যা বুঝি, সেরকম সত্য টাইপের এক কৃষ্ণ। অনেকে এমন একটা ঐতিহাসিক ভাবে সত্য কৃষ্ণের কথা বলেন। এই ‘সত্যের’ ভিত্তিটা অবশ্য জানা যায় না। আমরা এটা জানতে আগ্রহী। কোন সূত্রমতে এই কৃষ্ণ এতটা ঐতিহাসিক, এতটা সত্য হয়ে উঠল–সেটার বিশদ বিবরণ জানার অপেক্ষায় থাকলাম। সেটা পাওয়া গেলে–এখন যেমন আমরা মহাভারতের কৃষ্ণের, পৌরাণিক কৃষ্ণের, বৈষ্ণবসাহিত্যের কৃষ্ণের তথ্য নিয়ে সেসব ‘চরিত্র’ বিশ্লেষণ করি, তেমনি এই সত্য কৃষ্ণের ব্যাপারে সূত্রগুলোতে কী কী তথ্য আছে–জেনে বিশ্লেষণ করা যাবে।
Leave a Reply