পরিবর্তনটা হুট করে আসবে না। আবার পরিবর্তন একেবারে না আসাটাও সন্দেহজনক।
আমরা যতই বলি–নারী না হয়ে মানুষ হও, পুরুষ না হয়ে মানুষ হও–কঠিন তিতা সত্য বাস্তবতা হলো–কারো পক্ষেই ‘মানুষ’ হওয়া সম্ভব না। ভালো দিকের পাশাপাশি আমাদের ভুল-ভ্রান্তি থাকবে, দোষ-ত্রুটি থাকবে…থাকবেই। আর মানববাদ–সে তো আরো দূরের পথ। আরো কঠিন–এটাও কারো পক্ষে সম্ভব বলে মনে হয় না। তবে আমরা চেষ্টা করতে পারি।
সামনে পথের শেষ নেই। মানুষ হওয়া বা মানববাদী হওয়া–এই লাইনে পথের শেষ নেই। ঠিক কোথায় গেলে, কতদূর আগালে ওই দুইটা জিনিসের নাগাল পাওয়া যাবে–আমরা জানি না। আর জানি বলেই–অর্থাত এই পথের শেষ নাই বলেই এই জিনিসগুলা এত সুন্দর। তবে এই মানুষ হওয়া বা মানববাদী হওয়ার প্রথম পদক্ষেপই যে ‘নাস্তিক’ হওয়া–সে বিষয়ে অনেক তর্ক আগেই করা হয়ে গেছে। (কেউ নতুন করে জানতে চাইলে আবার বলতে আপত্তি নাই।)
নাস্তিক হওয়াটা খুব কঠিন কিছু না। আস্তিকতা জিনিসটা জন্মের একটা সময় পর থেকে সমাজ-পরিবারের মাধ্যমে আমাদের শরীর-মনে একটা জামা-কাপড়ের মত আবরণ হিসাবে জড়িয়ে পড়ে। পোশাকের মত এই আবরণটা খুলে ফেলা কঠিন কিছু নয়।
একটা দীর্ঘ সময়ধরে শুধু ধর্মের পেছনে লেগে ছিলাম। বিষয়টা খুবই সহজ ছিল। ধর্মের বিরুদ্ধে যুক্তি-তর্ক-তথ্য-প্রমাণ ধর্মগ্রন্থগুলোই সবচেয়ে বেশি জোগান দেয়। একটু কমনসেন্স নিয়ে সেগুলো পড়লেই হয়ে যায়। এই জিনিসগুলো নিয়েই অনেককাল পড়ে ছিলাম। তো আপনি এসব বুঝতে পেরে নাস্তিক হয়ে গেলেন মনে মনে, কিন্তু বাইরে সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে নানান ধর্মীয় ও সামাজিক প্রথা মেনেও চলতে পারেন। আপনি নিরাপদ। কারো সাথে আপনার বিরোধ নেই।
আবার নিজের নাস্তিকতার বিষয়টা পরিবারে-সমাজে প্রচার করে হাউকাউও বাঁধাতে পারেন। তখন স্বাভাবিক ভাবেই কিছু প্রতিবন্ধকার মুখোমুখি হবেন। আর যেহেতু যুক্তি-তর্ক বোঝেন, মাথায় কিছু আছে–তাই ওগুলো মোকাবিলা করে বেঁচে থাকার মত ক্ষমতাও আপনার থাকবে, আশা করি।
ওদিকে পরিবর্তনই শুনি জগতের নিয়ম–বিবর্তন বলতে পারি। আস্তিক থাকে নাস্তিক… নাস্তিক থেকে সামনে আরো অনেক কিছু–যেটা আগে বলেছি যে নাস্তিকতা হলো একেবারে প্রথম পদক্ষেপ। তারপর পথের আরো অনেক রয়েছে বাকি… কিন্তু আস্তিকদের যেমন বিবর্তন হয় না, আস্তিকতা যেমন একটা নির্দিষ্ট বিধিবিধানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা, একটা নির্দিষ্ট কুয়ার মধ্যে জীবনযাপন-গতিবিধি…ওদিকে নাস্তিকতা মানেই যদি মানবতার পথে মানুষ হওয়ার পথে প্রথম পদক্ষেপ ধরে আগাই, তাহলে আপনি দিন দিন সামনে আরো আগাবেন…আপনার লাইফে পরিবর্তন-বিবর্তন আসবেই। একটা সময়ে বুঝতে শিখবেন, ধর্ম শুধু সৃষ্টিকর্তায় সীমাবদ্ধ নয়–সৃষ্টিকর্তায় অবিশ্বাস করে শুধু নাস্তিক হয়েছেন মাত্র, কিন্তু আরো বুঝবেন যে ধর্ম মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে, নারী-পুরুষে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে, নারীদের অবজ্ঞা করে, তাদের অধিকার হরণ করে, ধর্ম পুরুষতন্ত্রের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে, ধর্ম সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে, ক্ষমতাবানরা এটাকে ব্যবহার করে অন্যদের শোষণ করার একটা মাধ্যম হিসাবে–আরো অনেক কিছু…
কিন্তু কেউ যদি দিনের পর দিন শুধু নাস্তিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন, তাহলেও ব্যাপারটা সেই আস্তিকদের মতই। পার্থক্য শুধু বিশ্বাস আর অবিশ্বাসে। পরিবর্তনের নিয়ম অনুসারে কোনো নাস্তিকদের মধ্যে যদি আর কোনো পরিবর্তন না আসে, তাহলে বুঝতে হবে এই নাস্তিকতা একটা ভড়ং মাত্র বা উদ্দেশ্যপ্রনোদিত। নিশ্চয়ই এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য সিদ্ধির পরিকল্পনা আছে–হতে পারে সেটা ব্যক্তিগত বা দলগত বা রাজনৈতিক স্বার্থ বা লোভ।
শুধু ধর্মের পেছনে থেকে থাকলেও নিজের অবস্থান অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন নারীদের সাথে, কোনো জনগোষ্ঠীর সাথে কোনো অন্যায়-অবিচার হলে আপনা থেকেই কিছু লেখার তাগিদ চলে আসে যা আগে হত না। খেয়াল করে দেখবেন একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ধর্মের বাইরে তেমন কিছুই লিখি নাই। সব কিছুতে খালি ধর্ম টেনে আনেন কেন–বিরক্ত হয়ে এমন মন্তব্য অনেকেই ছুঁড়ে দিয়েছিলেন।
নাস্তিকতার পরে সামনে এখন আরো অনেক কিছু দেখতে পাই–নারীবাদ, সাম্যবাদ…আরো অনেক কিছু… কিন্তু এই পথগুলো নাস্তিকতার মত সহজ-সরল নয়। আস্তিকতাকে যেভাবে যত সহজে এক টান দিয়ে খুলে ফেলা যায়–নারীবাদ-সাম্যবাদ–এসবে ততটা সহজ নয়। কারণ পুরুষতান্ত্রিকতা বোধ হয় জন্মের আগে থেকেই অস্থি-মজ্জায়-রক্তের সাথে মিশে আছে। পুরুষ হয়ে নারীকে নিজের সময় অধিকার দিতে গেলে নিজের লোভ আর স্বার্থে টান লাগে যে। একই ব্যাপার সাম্যবাদের বেলায়–বাপের বিষয়-সম্পত্তি আছে, সেগুলার উপর ভর করে বেশ আরামে জীবন পার করে দেয়া যায়, আমি কেন গরীবদের সমস্যা দুঃখ কষ্ট নিয়া ভাবতে যাব! আমি কেন চাইব আর সবাইও আমার মত ভালো থাকুক–এখানেও আমার নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিতে হবে যে! আমার টাকাপয়সা আছে, ক্ষমতা আছে–অন্যদেরকে দাসের মত খাটাতে পারি, তাদের উপর ক্ষমতা ফলাতে পারি…নিজের মধ্যে একটা রাজা রাজা ভাব–কে চায় এগুলা হারাতে! আমি চাইব শুধু আমার সন্তান-পরিবার যেন ভাল থাকে, নিজে মরে গেলেও একদিন সন্তানদের মধ্যে বেঁচে থাকব–সেলফিস জিন! সব ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে সমান করে দেখা, সবাইকে নিজের পরিবারের মত দেখার পথটা জটিল এবং কঠিন… তবে এটা ঠিক যে অনেক পথ চোখের সামনে দেখতে পাই–
আপনি যদি এগুলা না দেখতে পান, তাহলে ভেবে দেখেন আস্তিকদের মত আপনিও শুধু নাস্তিকতার কুয়ার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছেন কিনা।
২) এক সময়ে নাস্তিকতা নিয়ে খুব এক্সসাইটেড ছিলাম। আর সবাইকে এই লাইনে আনার সে কী অফুরন্ত চেষ্টা–আনলিমিটেড ধর্ম পুন্দানো… তর্ক-বিতর্ক, ক্যাচাল, গালাগালি, আরো কত কী! এমনকি পকেটের টাকা খরচ করে পেজের পোস্ট বুস্ট করা–যাতে নতুনদের কাছে এগুলা পৌঁছায়। কোথাও একটু পরিবর্তন দেখতে পেলে ভালো লাগত, সেগুলা ছিল নতুন করে প্রেরণার উৎস। চেঞ্জ না হলে আবার নতুন করে ভাবা–কোথায় সমস্যা হচ্ছে– নতুন টেকনিকে চেষ্টা…
যখন নতুন পথ পেয়েছি, কিন্তু সাথে যারা ছিল তাদের মধ্যে পরিবর্তন দেখি নাই, তখন মনে হয়েছে–ধুর! শেয়ার কুত্তার বাচ্চারাও তো ‘নাস্তিক’ হয়–এইটা বড় ব্যাপার না। অনেকের মধ্যে পরিবর্তন না দেখে সন্দেহ হয়েছে–তাহলে কি পরিবর্তনের যে নিয়মের কথা শুনতে পাই–সেগুলা কি ভুল? ভুল না হলে পরিবর্তন হচ্ছে না কেন…তাহলে কি এরা নির্দিষ্ট কোনো ধান্ধায় আছে যে নিজেদের লোভ-স্বার্থ বিসর্জন দিতে পারছে না? নাকি আরো সময় লাগবে?…
হয়তো সময় লাগবে, হয়তো অনেকে এইই ধান্ধায় থাকবে, পরিবর্তিত হবে না, হয়তো…
এই ‘হয়তো’র পরে একটা অসীম শূন্যতা… তবে সেটা অন্ধকারের নয়–আলোর… এই যে এত লেখালেখি এত হাউকাউ–সবই তো সেই আলোর অনুপ্রেরণাতেই…
Leave a Reply