লিখেছেন : কবিতা রায়
ভারতে বৌদ্ধধর্ম প্রায় লোপ পেতে বসলেও বুদ্ধের প্রতি বিদেশীদের ভক্তি অতি প্রবল ছিল। কারণ বুদ্ধের কারণেই ভারতকে দুনিয়ার লোকে চিনেছিল। গলায় দড়ি পরানো ছাগলের মতো সহজ শিকার হিসাবে চিনেছিল।
সম্রাট অশোক নিজে গদিটা পাবার পরেই রাজগদির সম্ভাব্য সব দাবীদারগুলোকে তুলে এনে প্রকাশ্য রাস্তায় মুন্ডচ্ছেদ করেছিলেন যাতে শত্রুর শেষ না থাকে। এরপর ভারতের একটাও রাজ্য স্বাধীন থাকা অবধি তিনি তলোয়ার চালানো বন্ধ রাখেননি। সব্বাইকে পায়ের তলায় এনে তারপর তিনি তাদের অহিংসা ধর্ম শেখাতে আরম্ভ করলেন যাতে আর তারা মাথা তুলে বিদ্রোহ না করে।
স্বল্পমেয়াদে এই পদ্ধতি ভালই কাজ দেয়। রাজার হাতে থাকে শক্তিশালী সেনাবাহিনী আর জনগণ হয় অহিংস। কিন্তু কয়েক প্রজন্ম ধরে চলতে থাকলে বিরাট সমস্যা দেখা দেয়। রাজার সেনাবাহিনী আকাশ থেকে আসেনা, জনগণের মধ্যে থেকেই সৈন্য বাছাই করে নিতে হয়। দেশের প্রায় সব পরিবারই অহিংসা আর শান্তির ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গেলে সেখান থেকে পাওয়া সৈন্যরাও আর লড়াইয়ের যোগ্য থাকেনা। বিদেশি আক্রমণ না হওয়া অবধি অবশ্য সেই অহিংস সেনা দিয়েই কাজ মোটামুটি চলে যায়।
সারা দুনিয়াতে প্রচারক পাঠিয়ে অশোক ঢাক পিটিয়ে জানালেন যে ভারতবর্ষ হিংসা ত্যাগ করেছে। ফলে দুনিয়ায় যত চোরডাকাত-লুটেরা ছিল সবাই ভারতের দিকে নজর দিল। এইসব বিদেশী দখলদারেরা শুরু থেকেই চাইছিল দেশি জনগণ অহিংস হয়ে থাকুক। তাই তাদের কাছে বুদ্ধের কদর ছিল খুব বেশি। কুষাণরাজ কণিষ্ক নিজে চীন সাম্রাজ্য দখল করার জন্য বিরাট ফৌজ নিয়ে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু যাবার আগে প্রায় দশ বছর ধরে পুরো দেশে বুদ্ধের মন্দির আর মূর্তি বসিয়ে প্রচার করেছিলেন যাতে তিনি সৈন্য নিয়ে বাইরে চলে গেলেও নিজের রাজত্বে প্রজাদের সামলানো সহজ থাকে। কোনোরকম বিদ্রোহ না হয়।
বাংলার সুলতানি আমলেও বাঙালিদের পক্ষে রামের বা কৃষ্ণের বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধকাহিনী নিয়ে আলোচনার অনুমতি ছিল না। এমনকি চৈতন্য যখন শুধুমাত্র রাম আর কৃষ্ণের নামটুকু ফাটা রেকর্ডের মতো গাইতে আরম্ভ করলেন তাতেও আপত্তি উঠেছিল। এখনও বাঙালিদের এলাকায় রামের কোনো মন্দির নেই। কৃষ্ণের পুজোর প্রচলন থাকলেও সেটা অস্ত্রধারী কৃষ্ণের নয়। কালীপুজো বাঙালি রাতের অন্ধকারে করত এবং সকাল হবার আগেই বিসর্জন দিত। অস্ত্রধারী দূর্গার পুজো ইংরেজের আমলে শুরু হয়েছিল।
বাংলার সুলতানেরা হিন্দুদের মধ্যে অহিংসা প্রচারকে খুবই ভালভাবে স্পনসর করতেন। ইস্ট ইন্ডীয়া কোম্পানীর অবশ্য লড়াই-ঝগড়া হলেই সুবিধে ছিল, তাই তারা অহিংসা শেখাতে যায়নি। উলটে বামুনদের দিয়ে গীতার অনুবাদ করে প্রচার আরম্ভ করেছিল। ব্রিটিশ রাজসরকার ভারতের অধিকার হাতে নেবার পরে অহিংসা প্রচারের কাজটা শুরু করে। কংগ্রেস পার্টি এর প্রধান উদাহরণ হলেও একমাত্র নয়। লর্ড কার্জন বাঙালিকে দুর্বল করার জন্য বাংলা ভাগ করেছিলেন কিন্তু সেটাই ওনার একমাত্র ফন্দি ছিল না। তিনি শ্রীলঙ্কা থেকে ভিক্ষু আমদানি করিয়ে কলকাতায় বৌদ্ধদের আখড়া মহাবোধি সোসাইটি খুলেছিলেন। তারই অন্তিম পরিণতি হয় আম্বেদকরের পার্টি এবং যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল।
Leave a Reply