লিখেছেন : কবিতা রায়
বুদ্ধ যা ভাবতেন তার সাথে বাস্তবের প্রচুর তফাত ছিল। আজকাল লোকে বুদ্ধকে যা ভাবে তার সাথেও বুদ্ধের অনেক তফাত।
সেকুলারবাদীরা বুদ্ধকে ভগবান বানিয়ে অলৌকিক হাওয়া দিতে চাইলেও আদতে বুদ্ধের তত্বে কোনোরকম অলৌকিক বিষয় ছিল না। বুদ্ধের ইচ্ছা ছিল সবরকম দুঃখের সমাধান খুঁজে বের করা। কিন্তু শেষ অবধি তিনি বুঝেছিলেন যে বাকি সব সমস্যার সমাধানের উপায় থাকলেও জরা-ব্যধি-মৃত্যুর কোনো সমাধান নেই। তাই এগুলোকে দুঃখ হিসাবে না ধরে স্বাভাবিক ঘটনা বলে ধরে নেওয়াটাই একমাত্র পথ। এই তিন তাপ থেকে মুক্তি পেলেই প্রাণ ঠান্ডা হবে, যেমনটা আগুন নিভে গেলে প্রদীপ ঠান্ডা হয়। এই আগুন নিভে গিয়ে Just Chill বলে একটা Cool Life কাটানোকেই নির্বাণ বলা হয়েছে। অর্থাৎ ত্রিতাপের নির্বাণ। তার সাথে অন্যসব সমস্যারও নির্বাণ হলে মনে আর দুঃখ থাকবেনা।
কাহিনীতে পাওয়া যায়, এই শিক্ষা দেবার জন্য বুদ্ধ এক পুত্রহারা মাতাকে একমুঠি সরিসা আনতে বলেছিলেন। সেটা এমন জায়গা থেকে আনতে হবে যেখানে কেউ কোনোদিন মরেনি। বহু জায়গা ঘুরেও যখন তেমন জায়গা পাওয়া গেলনা, তখন পুত্রহারা মাতা বুঝলেন যে দুনিয়ায় সকলেরই প্রিয়জন মারা যায়, তারপরেও তাদের জীবন চালু থাকে। সাধারণত বেশ আনন্দেই চলে। বুদ্ধের জন্মের আগে থেকেও এরকমই চলত। জরা-ব্যধি-মৃত্যুর দুঃখে দেশের অধিকাংশ লোক রাস্তায় কেঁদে বেড়াচ্ছে এরকম ইতিহাসে কখনো ঘটেনি।
বুদ্ধ নিজে নির্বাণ লাভ করেছিলেন। অর্থাৎ সবরকম দুঃখের তাপ থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। কারণ তিনি অন্যের সমস্যাকে সমস্যা মনে করে সমাধানের চিন্তায় রাতের ঘুম নষ্ট করতেন না, Just chill মেরে Cool থাকতে পারতেন। নিজের সংসারকে তো নিজের মনে না করে ছেড়েই দিয়েছিলেন।
বুদ্ধ যখন বড় বড় ধনী লোকেদের টাকায় সঙ্ঘ বানিয়ে একদল ভিক্ষু নিয়ে বসবাস শুরু করলেন তখন অনেকেই তাঁর কাছে দুঃখ নিবারণের আশায় দীক্ষা নিতে যেত। এ নিয়ে যখন সমস্যা শুরু হল তখন বুদ্ধ তার এমন সমাধান বের করলেন যাতে Chill মেরে Cool থাকা যায়।
শ্বসুরবাড়ির অত্যাচারে জ্বালাতন হয়ে কিছু বউ ওনার কাছে দীক্ষা নিয়ে আশ্রমে ভরতি হয়ে গেছিল। পরে যখন শ্বসুরবাড়ির লোকেরা এসে ঝামেলা শুরু করল তখন বুদ্ধদেবের দুঃখহীন শান্তিময় মনে ব্যথা লাগল। তিনি বললেন স্বামীর অনুমতি ছাড়া বউদের দীক্ষা দেওয়া বন্ধ। খেল খতম, পয়সা হজম।
কিছু ক্রীতদাস এসে দীক্ষা নিয়ে ভিক্ষু হয়েছিল। তাদের মালিকেরা এসে ঝামেলা শুরু করল। মালিকদের পয়সার জোর ছিল, তাদের সাথে ঝামেলায় গেলে কপালে দুঃখ আছে। তাই বুদ্ধদেব ঘোষণা করে দিলেন ক্রীতদাসদের জন্য প্রব্রজ্যা অনুচিত।
ঋণের দায়ে বেগার খেটে জীবন কাটানো কিছু গরীব এসে ভিক্ষু হয়েছিল। তাদের মহাজনেরা এসে ঝামেলা আরম্ভ করল। বুদ্ধ বললেন ঋণী ব্যক্তির জন্য প্রব্রজ্যা অনুচিত।
মহারাজ বিম্বিসার বুদ্ধের পরম ভক্ত ছিলেন। রাজা এত ভক্তি করেন দেখে প্রথমে রাজার কর্মচারীরা বুদ্ধের পায়ে পড়তে লাগল। তারপর দেখা গেল রাজার সৈন্যরাও গিয়ে বুদ্ধের কাছে দীক্ষা নিচ্ছে। দেখে রাজা তো ক্ষেপে লাল। সৈন্যরা অহিংস হয়ে গেলে রাজত্ব চলবে কিসের জোরে? রাজা ক্ষেপেছে দেখে বুদ্ধকে সমাধান বের করতেই হল। তিনি বললেন রাজসৈনিকদের প্রব্রজ্যা অনুচিত।
সোজা কথায় বউয়ের পিঠে শ্বসুরবাড়ির চেলাকাঠ, ক্রীতদাসের পিঠে মালিকের চাবুক, গরীবের পেটে মহাজনের লাথি কিম্বা সৈন্যদের উপরে রাজার হুকুমদারির মতো বাস্তব জীবনের সমস্যার কোনো সমাধানই বুদ্ধের কাছে ছিল না। বরং এইসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে যেন কোনো হিংসাত্মক বিদ্রোহ না হয় সেটাই তিনি নিশ্চিত করেছিলেন, কোনো বিরাট বিপ্লব করে যাননি। মালিকদের মনে করুণা জাগলে একদিন তারা নিজেরাই এসব অত্যাচার বন্ধ করবে, এই আশা নিয়েই বুদ্ধ ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু যতদিনে সেটা সম্ভব হতে পারত তার আগেই বিদেশ থেকে নতুন মালিকের দল আসতে শুরু করেছিল।
রাজসৈন্যদের দীক্ষা না দিয়ে তখনকার মতো রাজ্য বাঁচানো গেলেও সে সমাধান স্থায়ী হয়নি। রাজার সৈন্য আকাশ থেকে পড়েনা, জনগণের মধ্যে থেকেই তাদের নেওয়া হয়। পরবর্তীকালে দেখা গেল রাজ্যের অধিকাংশ পরিবারই অহিংসাবাদী বৌদ্ধ হয়ে গেছে, তাদের ছেলেগুলোও জন্ম থেকেই অহিংসাবাদী। ফলে সেখান থেকে সংগ্রহ করা রাজসৈন্যরাও সেরকমই অপদার্থ হয়েছিল। একদা যে ভারতের ভয়ে আলেকজান্ডার পালিয়েছিল সেই ভারত বিদেশী ডাকাতদের কাছে স্বর্গ হয়ে দাড়াল।
Leave a Reply