বাংলা ভাষায় এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন যে দুই লাইন লিখেছে বা দুইটা কথা বলেছে অথচ তার লেখায় বা কথায় #সরলীকরণ নেই। অথচ এই সরলীকরণ করার জন্য দোষ হচ্ছে শুধু নারীবাদ নিয়ে ইদানিং ফেসবুকে চিল্লাফাল্লাকারীদের।
বাংলায় নারীবাদের সূচনা যে নারীর হাত ধরে বলা হয়, সেই রোকেয়ার লেখাতেও কী পরিমাণ সরলীকরণ আছে, পুরুষতন্ত্রের পাশাপাশি তিনি কিভাবে পুরুষদেরকেও আক্রমন করে গেছেন, সেটা উনার লেখার লাইনে লাইনে প্রমাণিত। আবার নারীবাদ নিয়ে তাত্ত্বিকভাবে হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন ‘নারী’ গ্রন্থটি। বইটি পুরো মৌলিক না হলেও অর্থাৎ কিছু বিদেশী লেখকদের লেখার অনুবাদ হলেও রবীন্দ্রনাথ, রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, রোকেয়া–এনাদেরকে নিয়ে লিখিত প্রবন্ধগুলো অনেকটাই মৌলিক–আজাদের নিজস্ব মতামত।
হুয়ায়ুন আজাদ রোকেয়া সম্পর্কে লিখেছেন–“‘পুরুষ’ ধারণাটি রোকেয়ার ধারাবাহিক আক্রমণস্থল : তিনি উপহাস করেছেন পুরুষকে, তাকে গণ্য করেছেন পশুর থেকেও নিকৃষ্ট, আদমের কাল থেকেই পুরুষকে দেখিয়েছেন নির্বোধরূপে। পুরুষ তার চোখে প্ৰতারক আর পীড়নকারী। প্রাচীন কাল থেকে বিশ্বজুড়ে চলে এসেছে নারীবিদ্বেষের যে-ধারাটি, রোকেয়া একা যেনো তাকে প্রতিরোধ করতে চেয়েছেন প্রচণ্ড পুরুষবিদ্বেষের সাহায্যে। পুরুষ তাঁর নিরন্তর আক্রমণলক্ষ্য, কেননা পুরুষ নারীকে পরিণত করেছে দাসীতে, পুরুষ কেড়ে নিয়েছে নারীর স্বাধিকার ও স্বাধীনতা;…।”
আমরা দেখতে চাইছি রোকেয়ার লেখায় #পুরুষতন্ত্রকে আক্রমণ করার পাশাপাশি #সরলীকরণ করে #পুরুষকেও আক্রমণ করেছেন কিনা, কিংবা তার লেখায় #পুরুষবিদ্বেষ আছে কিনা। যারা রোকেয়া পড়েছেন, তাদের চোখে এগুলো ধরা পড়ার কথা। যারা পড়েন নাই, তারা রোকেয়া সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদের বিশ্লেষণটাই যথেষ্ঠ হওয়ার কথা।
হুমায়ুন আজাদ রোকেয়ার লেখা থেকে কিছু কোটেশন দিয়েছেন এভাবে–“তিনি পুরুষকে বলেছেন, ‘নিরাকারে পিশাচ’ (‘গৃহ’, রোর, ৭৩); বলেছেন, ‘ডাকাতী, জুয়াচুরি, পরস্বাপহরণ, পঞ্চ ‘মকার’ আদি কোন পাপের লাইসেন্স তাঁহাদের নাই’ (পদ্মরাগ : রোর, ৩৩৪)? বাঙালি পুরুষকে পরিহাস ক’রে বলেছেন, ‘ভারতের পুরুষসমাজে বাঙ্গালী পুরুষিকা’ (‘নিরীহ বাঙ্গালী’, রোর, ৩২)! পদ্মরাগ-এর সকিনা লতিফকে বিদ্রুপ করে বলেছে, ‘খোদাতালার সৃষ্টিজগতের সর্বশ্রেষ্ঠ জীব পুরুষ হইয়াছেন, ইহা অপেক্ষা আর কি বাঞ্ছনীয়’ (রোর, ৩৫২)? এক বাক্যে তিনি কাঁপিয়ে দিয়েছেন পুরুষ ও তার স্রষ্টাকে। পুরুষকে বলেছেন প্রতারক : বহুকাল হইতে পুরুষ নারীকে প্রতারণা করিয়া আসিতেছে, আর নারী কেবল নীরবে সহ্য করিয়া আসিতেছে’ (রোর, ২৭৮)। বলেছেন, ‘কুকুরজাতি পুরুষাপেক্ষা অধিক বিশ্বাসযোগ্য। (‘ডেলিশিয়াহত্যা’, রোর, ১৬২); যদি স্বার্থপরতা, ধূৰ্ততা ও কপটাচারকে সদগুণ বলা যায়, তবে অবশ্য পুরুষজাতি কুকুরের তুলনায় শ্রেষ্ঠ’ (রোর, ১৭০)! পুরুষ তাঁর চোখে অলস, বলেছেন : ‘অলসেরা অতিশয় বাকপটু হয়’ (‘সুলতানার স্বপ্ন’, রোর, ১৩৫)।”
কিছুদিন আগে “#কুকুরজাতি_পুরুষাপেক্ষা_অধিক_বিশ্বাসযোগ্য” এই কথাটা একটি কোলাজে ব্যবহার করেছিলাম। সেটা নিয়ে অনেক জ্ঞানীগুণীদের চুলকানি ছিল দেখার মত। কথাটা নাকি রোকেয়ার নয়, ওটা একটা কুত্তার মুখের কথা, তাও আবার অনুবাদ করা। এখানে দেখতে পাচ্ছি–হুমায়ুন আজাদও সেই একই ভাবে কথাটা রোকেয়ার নাম দিয়েই কোট করেছেন! (এ জন্য হুয়ায়ুন আজাদের জন্য কতটা #পুন্দানি বরাদ্দ করা যেতে পারে?)
এখন কথা হচ্ছে–পুরুষতন্ত্র খারাপ–এই ব্যাপারটা সবাই স্বীকার না করলেও অনেক জ্ঞানীগুণী মিনমিন করে হলেও স্বীকার করেন; এবং সেই সাথে কিছু ‘তবে কিন্তু যদি’র লেজুড় জুড়ে দিয়ে বলতে চান যে, সব পুরুষ এক না। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না–সব পুরুষ এক নয়, এটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম উদাহরণ হতে পারে না বলেই রোকেয়া থেকে শুরু করে আজাদ পর্যন্ত “পুরুষেরা” শব্দটি ব্যবহার করেছেন। #সরলীকরণ না করে বাংলাতে ওই ধরনের বাক্যরচনা রোকেয়া-আজাদ–কারোরই জানা ছিল না। আমারও জানা নেই।
[সেইরাম লেভেলের হিপোক্রেসি–“পুরুষেরা” শব্দটিতে অনেকের আপত্তি, কিন্তু হাজার হাজার বছর ধরে লেখায়-কথায় ব্যবহার করে আসা “নারীরা” শব্দটিতে আজ পর্যন্ত এদের কারো কোনো আপত্তি দেখলাম না!]
Leave a Reply