‘সুখে থাকা হলো না আমার…’
নাহ্, কোনো প্রেম-বিরহের ব্যাপার নয়। মাথার মধ্যে প্রশ্ন ঢুকে গেছে–নিজের সম্পর্কে, তার সম্পর্কে, আপনার সম্পর্কে… আর ফাইনালি–ধর্ম সম্পর্কে… কৌতূহলী মন সুখের অন্তরায়…
কত কৌতূহল… কত প্রশ্ন মাথার মধ্যে! উত্তর জানা নেই বলে নিজেকে অশিক্ষিত-মূর্খদের দলেই রাখি। তবুও, মূর্খ হলেও আমি সুখী না। তবে জাতি হিসাবে আমরা, বাঙালিরা, অশিক্ষিত-মূর্খদের কাতারে পড়লেও সার্বিক ভাবে সুখী। অল্পতেই আমরা সুখী।
সেই-যে কিছুদিন আগে সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে উপরের দিকে থাকতে দেখে অনেকেই অবাক হয়েছিলেন, হাসি-ঠাট্টা করেছিলেন, কিন্তু আমি অবাক হই নি। মূর্খ-অশিক্ষিত হয়েই জীবন পার করে দেয়, ফলে বলা যায়–বাঙালিরা জন্মগত ভাবেই সুখী।
বাঙালিরা কতটা সুখী, তার একটা প্রমাণ পাওয়া যায় এদের দিকে ক্যামেরা তাক করলে। দেশের বাইরে আত্মীয়-স্বজন থাকাতে ক্যামেরার অভাব ছিল না। কিন্তু আমার ছবি তোলার অভ্যাস ছিল না কোনোদিনও। ক্যামেরার হাত ভালো ছিল বিশুর। আশেপাশে কোনো অনুষ্ঠান হলেই বিশুর ডাক পড়ত। আমাকে সাথে নিয়ে যেত। ক্যামেরা টাক করলে দু-চারজন মুখ সরিয়ে নিলেও বেশিরভাগেই হাসিমুখে পোজ দিত।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার লক্ষ্য করেছি মরা বাড়িতে। যেই শুনত ছবি তোলার লোক আসছে–অমনি কান্না থেমে যেত। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ত লাশটিকে সাজিয়ে তুলতে। যারা কাপড়-চোপড় এলোমেলো করে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছিল, তারাও কাপড় ঝেড়ে উঠে ঠিকঠাক উঠে দাঁড়াত। তারপর লাশটিকে চেয়ারে বসিয়ে আত্মীয়-স্বজনেরা সবাই পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য পোজ দিত। হাসি পেত লোকগুলোর দ্বিধাদ্বন্ধ দেখে–তারা হাসবে, নাকি মুখটা কাঁদো কাঁদো করে রাখবে–এসব ভেবে সমস্যায় পড়ে যেত।
আবার ধরুন কারো একক ছবি তোলা হচ্ছে। পাশ থেকে কেউ না কেউ হাসিমুখে ঘাড় বাঁকা করে ফ্রেমে মাথা ঢুকিয়ে দেবে। একজনকে সরিয়ে দেয়া হয় তো আরেকজন অন্য পাশ দিয়ে ঢুকে পড়ে। ইদানিংকার সেলফিগুলোতেও এমন। কেউ বা কারা নিজেদের সেলফি তুলছে তো অপরিচিত কাউকে দেখা যাবে দূর থেকে হাসি মুখে তাকিয়ে আছে ক্যামেরার দিকে!
গ্যালারিতে কারো দিকে ক্যামেরা ধরলে আশেপাশের লোকগুলোও দৌড়ে আসে, কিংবা ঘাড় কাত করে দেয়ে ফ্রেমে। কোনো দুঃখজনক ঘটনায় ভিডিও ক্যামেরায় কারো সাক্ষাতকার নিতে গেলে পেছনে কারো হাসিমুখ ধরা পড়বেই। সেদিন সাঁওতালদের গ্রাম পুড়িয়ে দেয়ার পরে যখন ক্যামেরা নিয়ে সাংবাদিকরা সাক্ষাতকার নিচ্ছিল, ছেলে-মেয়েদেরকে দেখা গেলো হাসিমুখে ক্যামেরার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে। বস্তিতে আগুন লাগলেও ছেলে-মেয়েরা এমন করে।
আজকাল হসপিতালের বিছানায় শোয়া মুমূর্ষু রোগীর পাশে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে পোজ দেয়ার মানুষেরও অভাব নেই। আবার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে–চোখে জল–মুখে হাসি–ক্লিক! হয়ে গেলো অসাধারণ একটি সেলফি। কেউ নিজের কান্নার ছবি তুলছে হাসিমুখে। ছবি তোলার যে কী সুখ! সুখেরই আরেক নাম সেলফি।
আমরা সুখী মানুষ, ক্যামেরার দিকে তাকালে সেই সুখটা তেল-তেলে হয়ে ভেসে ওঠে। এই জিনিসটা ক্যামেরাবন্দি হবে ভেবে আমরা আরো সুখী হয়ে উঠি। কেউ কেউ শুনি ভালো ছবি তুলে দিলে ‘সর্বস্ব’ দিয়ে দিতেও রাজি। ওদিকে বিপ্লবী-প্রতিবাদকারীদেরও দেখা যায়–মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে তীব্র প্রতিবাদ, ক্যামেরা তাক করলেই মুখটা কেমন হাসি হাসি। আমাদের এত সহজে সুখী হওয়ার আর কোনো উপায় জানা নেই! এসব দেখে বিরক্ত হয়ে বিশু ছবি তোলাই ছেড়ে দিল। না হলে বলতাম–আমার কিছু ছবি তুলে দিতে।
[ছবিতে বিপ্লবী চে’কেও মনে হয় যেন রোমান্টিসিজমের অন্যতম পুরোধা তিনিই।]
সহমত