লিখেছেন : কবিতা রায়
কমরেডদের কাছে নিয়মিত শুনতে পাবেন যে ভারতের প্রায় সব জেলফেরত বিপ্লবীরা নাকি কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হয়েছিল।
যারা যুক্ত হয়েছিল তাদের দশজনের নাম আর তারা পার্টির কোন পদ সুশোভিত করেছিল জানতে চাইলে অবশ্য কেউ উত্তর দেবেনা। এরকম বিপ্লবীদের কতজনের ছবি পার্টি অফিসে আছে সেটাও দেখতে গেলে পাবেন না। কতজনের জন্মদিনে পার্টি অফিস থেকে ছবিতে একটা মালা দেওয়া হয় তারও হিসাব পাবেন না।
এই যেমন উদাহরণ হিসাবে ধরা যাক লক্ষ্মী সেহগল। আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্যাপ্টেন হিসাবে লড়েছেন। কাজেই দেশপ্রেম নিয়ে তো সন্দেহের কোনো জায়গা নেই। সিপিএমের নেতা ছিলেন, সিপিএম ওনাকে ভারতের প্রেসিডেন্ট পদে লড়তে নামিয়েছিল, তাই কমরেড হবার যোগ্যতা নিয়েও কোনো প্রশ্ন তোলা যায়না। আরো বেশি করে বলতে গেলে সিপিএম তাদের ইতিহাসে একবারই মাত্র প্রেসিডেন্ট পদে ক্যান্ডিডেট দিয়েছিল, সেটাও আব্দুল কালামকে আটকাতে। আর সেই ক্যান্ডিডেট ছিলেন লক্ষ্মী সেহগল। তাই কোনোদিক থেকেই কম মনে করার জায়গা নেই। এই মহান বিপ্লবীর মূর্তি কিম্বা ছবিতে ফুল-বেলপাতা দিতে দেখেছেন কি? ওনার জন্মদিনে পার্টি থেকে একটা ফেসবুক পোস্ট দেখতে পেয়েছেন?
এবার যারা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়নি সেরকম দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের কী হয়েছিল তারও উদাহরণ দেখা যাক। সে সময়ে কলেজ-ইউনিভার্সিটি পাশ করার পর সার্টিফিকেট বিতরণ করতে বাংলার গভর্ণর আসতেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই অনুষ্ঠানে সার্টিফিকেট নেবার জন্য উপস্থিত হয়ে বিপ্লবী বীণা দাস বাংলার গভর্ণর জ্যাকসনকে গুলি করেছিলেন। ফলে সেই সার্টিফিকেটের কাজগখানা না নিয়েই ওনাকে জেলে যেতে হয়েছিল। বীণা দাসকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন ঐ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হাসান সোহরাওয়ার্দী, তার বিনিময়ে পেয়েছিলেন স্যর খেতাব।
ইংরেজ চলে যাবার পর তিনি তথাকথিত স্বাধীন দেশে স্কুলমাস্টারি করতেন। সিপিএমের রাজত্বকালে ওনার পেনশন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, কারণ উনি সেই সার্টিফিকেটের কাগজখানা দেখাতে পারেননি। পদ্মশ্রী পুরষ্কারপ্রাপ্ত এই শিক্ষিকা পশ্চিমবঙ্গের পুরো শিক্ষা দফতর ঘুরেও ওনার গ্রাজুয়েশনের সার্টিফিকেটের একটা কপি পাননি। কারণটা শুনলে লোকে হাসবে। গভর্ণরের উপর গুলি চালানোর কারণে নাকি বাংলা সরকার ওনার সার্টিফিকেট স্থগিত করে দিয়েছিল। তাই বাংলা বিধানসভার অনুমতি ছাড়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সেই সার্টিফিকেট দিতে পারবেনা। আর বাংলার সেই বিধানসভা কোনোভাবেই অনুমতি দেয়নি। এই ছিল তথাকথিত স্বাধীন দেশের নমুনা। স্বাধীন ভারতে বীণা দাস হৃষিকেষের গঙ্গার ঘাটে বসে ভিক্ষা করে খেতেন এবং সেখানেই মরে পড়েছিলেন। সর্বহারার দলে থাকলে হয়ত উডল্যান্ডে যাবার সৌভাগ্য হত।
সিপিএম নামক এই আপদ বিদায় হবার পরে ২০১২ সালে বিধানসভার নির্দেশ পেয়ে বীণা দাস এবং প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে সেই স্থগিত সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। দেশ তথাকথিত স্বাধীনতা লাভ করার ৮০ বছর পরে।
এবারে যে কথাটা কমরেড কোনোদিন বলবেনা সেটায় আলোকপাত করা যাক। ভারতের বিপ্লবীরা কমিউনিস্ট পার্টিতে গেছিল এটা গলা তুলে বললেও মুসলিম লীগের জেহাদীরাও যে ঐ কমিউনিস্ট পার্টিতেই গেছিল সেটা কমরেড সহজে বলেনা। খোদ জ্যোতি বসুর লেখা ইতিহাস বলছেঃ “দেশভাগের পর মুসলিম লীগের যেসব প্রতিনিধি (পশ্চিমবাংলার বিধানসভায়) রয়ে গেলেন তাঁরা বিভিন্ন ইস্যুতে আমাদের সমর্থন করতেন।”
এর তিনমাস আগেই মুসলিম লীগের এই প্রতিনিধিরা কিভাবে ভোটে জিতে জনপ্রতিনিধি হলেন সেটাও জ্যোতি বসুর কাছেই জানা যায়। ১৯৪৭ সালে বাংলায় ভোটের বিবরণে জ্যোতিবাবু লিখেছেনঃ “যেখানেই দেখেছি, সর্বত্র লীগের গুন্ডারা বুথ জ্যাম আর রিগিং চালাচ্ছে।”
নিয়ম মেনে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করার পর শুধু সার্টিফিকেটখানা ইংরেজরা স্থগিত করে গেছিল বলে বীণা দাসের পেনশন আটকে গেল। এদিকে জ্যোতিবাবু নিজের চোখে দেখে যাদের রিগিং করে জিতে আসা নেতা বলছিলেন, মাত্র তিনমাস বাদেই সেগুলো সব ভালো হয়ে গেল। মার্ক্সবাদ কী অলৌকিক তত্ব না?
একেবারে শেষ লাইনের গল্প এই যে ১৯৬০ সালে নেহেরুর সরকার ওনাকে পদ্মশ্রী দিতে পেরেছিল কিন্তু ওনার সার্টিফিকেটখানা দিতে পারেনি। কারণ সেটা ইংরেজরা স্থগিত করে গেছিল। যারা মনে করে গান্ধীবাদীরা ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন করে গেছে, তাদের একটু এগুলো দেখা দরকার।
Leave a Reply