লিখেছেন : অন্নপূর্ণ দেবী
মুকছেদুল মুমেনীন বা বেহেস্তের কুঞ্জের সমস্তটা জুড়ে স্বামীর প্রতি স্ত্রীদের অনুগত আর বাধ্য থাকতে বলা হয়েছে। যে পরিমান ভয় নারীদেরকে এই বইয়ে দেখানো হয়েছে, তা যে কোন সুস্থ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ পড়লে নারী জাতীর প্রতি তার অতি তুচ্ছ তাচ্ছিল্য হীন নিচ ধারনার সৃষ্টি হবে। কোথাও কোন পৃষ্ঠায় বলা হয়নি পুরুষের কোন দোষ আছে বা তাদের স্ত্রীদের প্রতি করনীয় কিছু আছে। খাস স্ত্রীলোকের জন্য ৩৫ টি নছীহত অনুচ্ছেদে যেভাবে নছীহত দেখানো হয়েছে তা পরে বোধগম্য হয় নারী আসলে মানুষ নয় ।
০ সর্বদা পর্দা পুশিদায় থাকিয়া আপন আপন শরীরকে হারাম কাজ হইতে বাঁচাইবার চেষ্টা করুন। কারণ ইহাও ফরজ। (পুরুষের ইহার দরকার নাই কারণ তাদের শরীর সহ সকল কাজ হালাল।)
০ স্বামী অমূল্য ধন। সর্বদা তাহার সহিত সদ্ভাব রাখিয়া চলিতে থাকুন। (স্ত্রী কিরুপ ধন কোথাও বলা নাই। স্ত্রী সস্তা, মূল্যহীন, তাহার সহিত সদ্ভাবের কোথাও কোন উল্যেখ নাই।)
০ স্বামীকে কখনো নিজের উপর অসন্তুষ্ট হতে দিবেন না। তিনি যে ইশারায় চালাইতে চাহেন সেই ইশারায় চলিতে থাকুন । আপনার স্বামী যদি আপনাকে বলেন , তুমি দুই হাত বান্ধিয়া সমস্ত রাত্রি আমার কাছে দাঁড়াইয়া থাকো, তথাপি তাহাতে বাধ্য হউন। তাহা হইলে খোদা ও রাসুল আপনার উপর সন্তুষ্ট থাকিবে। ( স্বামীকে দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে ইসলাম ধর্ম। এক্ষেত্রে ধর্মপ্রাণ নারীরা কেবলমাত্র ইশারার গোলাম।)
০ কখনো স্বামীকে এরকম কথা বলিবেন না, যাহাতে তাহার দেল আপনার উপর অসন্তুষ্ট হইয়া যায় ।
(যদিও স্বামী খারাপ কাজ করে তবুও কিছু বলা যাবে না। কারণ উনার দিল অসন্তুষ্ট হলেই মহাবিপদ।)
০ আপনাদের স্বামী যদি আপনাদিগকে কখনো কোন কাজে ডাকেন , তৎক্ষণাৎ চোখের ইশারায় হাজির হউন এবং যে মুখছেদে ডাকিয়াছেন তাহা বিনা আপত্তিতে পুরা করতে চেস্টা করুন। (অনুগত দাসীরাও তাদের অমতে কিছু হলে আপত্তি জানাতে পারে, কিন্তু স্ত্রী নামক ব্যক্তি তা করতে পারবে না।)
০ আপনাদের স্বামী আপনাদের নিকট থাকিতে কখনো তাহাঁদের বিনা হুকুমে নফল নামায, নফল রোযা, এবং নফল ইবাদত ইত্যাদি কারয করিবেন না এবং তাহাঁদের অগ্রে খানা খাইবেন না । (ক্ষুধায় মরে গেলেও আগে খাবার খাওয়া মানা।)
০ স্বামীর বিনা হুকুমে তাহার ঘরের কোন মালপত্র , টাকাকড়ি, কাহাকেও দিবেন না । দান খয়রাতও করিবেন না, প্রতিবেশির বাড়ি এবং কুটুম্বালয়েও যাদেন না। কারণ স্বামির বিনা হুকুমে ওই সমস্ত কাজ করা মহাপাপ। (নারীকে চোর ছ্যাচ্চর বোধ বুদ্ধিহীন মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। উপরন্তু মহাপাপ সতর্কবাণী।)
০ স্বামীর কোন দোষের কথা কখোনো অন্যের নিকট প্রকাশ করিবেন না। সর্বদাই স্বামীর সুখে সুখী হইবেন , তাহার দুঃখে দুখি হইবেন । (স্ত্রীর নিজের সুখ দুঃখ বলে কিছু নাই, সব তার উপর নির্ভরশীল।)
০ সকল সময় স্বামীর মেজাজ বুঝিয়া ব্যবহার করিতে থাকুন। যখন দেখিবেন স্বামী হাস্যবদনে আছেন তখন হাসিয়া হাসিয়া ব্যাবহার করুন, যখন গম্ভীর আছেন তখন হাসিয়া না ব্যবহার করলেও চলবে। হয়তো রাগিয়া উঠিলে মার ও দিতে পারেন। (কারণ মাইরের উপ্রে ঔষধ নাই। জয় পতি দেবতা।)
০ স্বামী যদি কোন ত্রুটি পাইয়া আপনাদিগকে মারেন গালাগালি করেন তজন্য চুপচাপ গাল ফুলাইয়া মনের রাগে দূরে সরিয়া থাকিবেন না। বরং হাতে পায়ে ধরিয়া অনুনয় বিনয় করিয়া যাহাতে তাহাকে সন্তুষ্ট করিতে পারেন তার ব্যবস্থা করুন। (চুপচাপ মার খেয়ে অতপর স্বামীর হাত পায়ে ধরিতে হইবে।)
এরকম ৩৫ টি নছিহত আছে বইটিতে। তাছাড়া আছে স্ত্রীলোকের দশটি দোষের কথা , গর্ভধারিণীর কর্তব্য , ছেলেমেয়ে লালন পালনের পদ্ধতি ইত্যাদি। বইটি স্বামীকে উপরে তুলিতে তুলিতে আসমানে উপনিত করেছে, অন্যদিকে স্ত্রীকে নিচে নামাইতে নামাইতে অতলে নিমজ্জিত করেছে।
এরকম বৈষম্য সম্বলিত বই, যা নাকি বেহেস্তের কুঞ্জ নামে বিরাজমান তা না মেনে নারী জাতির উপায় কী? বেহেস্তের এমন মন্ত্র হাতের কাছে পেয়ে কেউ তা মানবে না তা কী করে হয়? কারণ তারা তো সবাই ঈশ্বরে অবিশ্বাসী নন। এই বই বাংলা ঘরে ঘরে বহুল পঠিত, প্রায় প্রতিটা নারীর কাছে পরম যত্নে সমাদৃত। এর বিপরীতে কিছু বলতে বা করতে গেলেই সম্মুখে দোজখের ভয়। আমাদের ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার শিক্ষা দেয় নারীকে এভাবে ওভাবে চলতে হবে, চললে ভাল-বেহেস্ত মিলে যাবে, তারাই নীতি নির্ধারক আর তারাই বেহেস্তের প্রবক্তা; এগুলো নারীরা মানতে তো একরকম বাধ্যই। কারণ কে আর সাধ করে নাস্তিকদের মত বেহেস্তে না যেতে ভালবাসে! এরপরও যারা বলেন নারীদের দুরাবস্থার জন্য নারীরাই দায়ী, তারা নিজ নিজ আংগুল আপন আপন গোঁয়ায় ঢুকাইয়া বসে থাকুন, এরপরেও না হলে উল্টাইয়া মাথা ঢুকায়া দেন।
Leave a Reply