প্রায় সব আস্তিকের একটা কমন স্লোগান আছে–আন্নে সুদু আমার ধর্মের পিছে লাগেন ক্যা? রঙ্গভরা বঙ্গদেশে স্লোগানটা আরো ক্লিয়ার–আন্নে নাস্তিক হইচেন বালও করছেন, তাই বলে সুদু ইছমাল ধর্মের ফুটা মারেন ক্যা? বালও নাস্তিকরা সব ধর্মের সমালোচনা করে, আর আন্নেরা সুদু ইছমাল ধর্ম নিয়া লিকেন… আন্নেরা নাস্তিক না, আন্নেরা ইছমাল বিদ্বেষী…ম্যা ম্যা ম্যা…
এই নিয়া নাস্তিক প্রগতিশীল সেক্যুলার মুক্তমনাদের কিছু যুক্তিযুক্ত উত্তর আছে–যেসব নাস্তিক সেসব ধর্মের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসছে, তারা স্বাভাবিক ভাবে সেই ধর্মের ব্যাপারেই বেশি জানবে, এবং সেই ধর্ম নিয়াই বেশি লিখবে। আরো–যখন যে ধর্মের প্রকোপ বেশি, স্বাভাবিক ভাবেই তখন সেই ধর্ম নিয়া বেশি লেখালেখি হবে। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই এখন এছমাল ধর্মটা হেডলাইন–ফলাফলে এইটা নিয়াই বেশি লেখালেখি… ইত্যাদি ইত্যাদি…
এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গ–সবাই জানেন ধর্মের ভিত্তিতে যখন ভারত ভাগ হচ্ছিল তখন পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন দিয়েছিলেন প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক (১৯১৪ – ১৯৯৯)। তিনি পরে আত্মপক্ষ সমর্থন করে যা বলেছিলেন সেটা আমরা জানতে পারি আহমদ ছফার সূত্রে–আব্দুর রাজ্জাক নাকি কইছিলেন–//…আপনেরা বাংলায় যত উপন্যাস লেখা আইচে সব এক জায়গায় আনেন। হিন্দু লেখক মুসলমান লেখক ফারাক কইরেন না। তারপর সব উপন্যাসে যত চরিত্র স্থান পাইছে রাম শ্যাম, যদু মধু, করিম রহিম নামগুলা খুঁইজ্যা বাইর করেন। তখন নিজের চৌকেই দেখতে পাইবেন, উপন্যাসে যেসব মুসলমান নাম স্থান পাইছে তার সংখ্যা পাঁচ পার্সেন্টের বেশি অইব না। অথচ বেঙ্গলে মুসলিম জনসংখ্যার পরিমাণ অর্ধেকের বেশি। এই কারণেই আমি পাকিস্তান দাবির প্রতি সমর্থন জানাইছিলাম।//–সোজা বাংলায়–এইখানে অভিযোগটা পুরাই উলটা–‘হিন্দু লেখকরা’ শুধু হিন্দু ধর্ম হিন্দু সমাজ হিন্দু চরিত্র নিয়া লেখে ক্যা? কিন্তু উত্তরটা সেই নাস্তিকদের উত্তরের মত একই থাকবে–হিন্দু লেখকরা তাদের ধর্ম সমাজ চরিত্র সম্পর্কে বেশি ভালো জানে বলে সেটাই তাদের পক্ষে ভালো করে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব…
এছাড়াও আরো একটা ব্যাপার আছে–‘হিন্দু লেখকরা’ তাদের রচিত ‘হিন্দু সাহিত্যে’ হিন্দুধর্ম দেবদেবী ঈশ্বর ভগবান ইত্যাদি নিয়া যেমনে হাসি ঠাট্টা মস্করা তাফালিং করছেন বা করেন, ওই একই স্টাইলে তারা ইছমাল ধর্ম নিয়া যদি ওই পাঁচ পার্সেন্ট তো দূরের কথা, এক পার্সেন্টও যদি লিখতেন, তাদের ঘাড়ে কল্লা থাকত কি না সন্দেহ। ওদিকে রবীন্দ্রনাথ তেমন কিছু না লেইখাই ইছমাল-মুসমাল-বিদ্বেষী ত্যাগ খাইয়া বইসা আছেন। আমার মনে হয় ‘হিন্দু-লেখকরা’ এই কারণেই সচেতন ভাবে ছেঞ্ছিটিভ ইছমাল-বিষয়ক কিছু লেখা থিকা বিরত থাকছেন বা থাকেন। যারা বিরত থাকতে পারছেন না–তারা ইছমাল-বিদ্বেষী ট্যাগ খাইছেন বা খান। মজার ব্যাপার হলো–এই ধরনের ট্যাগ অনেক নাস্তিক প্রগতিশীল সেক্যুলার মুক্তমনা নামধারীরাও দিয়া থাকে।
এখন সার্বিক ভাবে যদি দেখতে বলেন, তাহলে বলব–হ্যাঁ, ওইসব ‘হিন্দু-লেখকদের’ দোষ আছে। তারা সমালোচনার ভয়ে, কল্লা বাঁচাইতে, জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে বা আর যে কোনো কারণেই হোক–ইছমাল নিয়া না লিখা ভুল করছেন।
একইভাবে দোষ দেয়া যায় রামায়ণ-মহাভারত থেকে শুরু করে প্রাচীন সব সাহিত্যের লেখকদেরকে। দেয়া হয়ও। তাদের ব্যাপারে বলা হয়–তারা সযতনে সমাজের বৃহৎশ্রেণী–নিচু জাত–খেটে খাওয়া মানুষদেরকে উপেক্ষা করে গেছেন। তাদের লেখাতে শাসকশ্রেণীর জয়গান কিংবা উচ্চবিত্তের কাহিনীই বেশি। কিন্তু উপায় কী! উদাহরণ তো শত শত–শাসকশ্রেণীর বিপক্ষে লেখালেখি করে চার্বাকরা তো ধ্বংস হয়ে গেল… বর্তমানেও কল্লা হারাতে হচ্ছে…
কী কইতে কী কইয়া ফেললাম…লেখাও দেখি অনেক বড় হয়ে গেলো– বড় লেখা কেউ তেমন একটা পড়ে না। তাই বড় যখন হয়েই গেলো তো আরেকটু বড় করি– হুমায়ূন আহমেদের ‘মধ্যাহ্ন’ থেকে একটু অংশ তুলে দেই–
//মাওলানা ইদরিস তাকিয়ে আছেন। তাঁর গায়ে কম্বল। খোলা জানালা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে কম্বলের ওপর। মাওলানা কিছুক্ষণ রোদ দেখলেন, তারপর দৃষ্টি ফেরালেন ঘরের মেঝের দিকে। সেখানে কৃশকায় কৃষ্ণবর্ণের এক যুবক মাটিতে আসন করে এই শীতে খালি গায়ে বসেছে। তার গায়ের পৈতা ঝকঝক করছে।
যুবক একমনে লিখে যাচ্ছে। একসময় এই যুবক লেখা থেকে চোখ তুললেন।
তখনি মাওলানা ইদরিসের সঙ্গে তাঁর চোখাচোখি হলো।
যুবক বললেন, আজ কি একটু ভালো বোধ করছেন? মাওলানা বললেন, জি জনাব। আপনার নাম?
আমার নাম তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়।
কী লিখছেন?
একটা উপন্যাস লিখছি। উপন্যাসের নাম ‘গণদেবতা’। ভারতবর্ষে নামে একটা পত্রিকা আছে সেখানে ধারাবাহিকভাবে বের হয়।
মাওলানা বললেন, আমি গল্প-উপন্যাস কোনোদিন পাড়ি নাই। হাদিস কোরান পড়েছি। কী লিখেছেন একটু পড়ে শুনাবেন?
তারাশংকর বললেন, অবশ্যই।
‘সোঁ সোঁ শব্দে প্রবল ঝড়। ঝড়ে চালের খড় উড়িতেছে, গাছের ডাল ভাঙিতেছে। বিকট শব্দে ওই কার টিনের ঘরের চাল উড়িয়া গেল। কিছুক্ষণ পরই নামিল ঝমঝম করিয়া বৃষ্টি। দেখিতে দেখিতে চারদিক আচ্ছন্ন করিয়া মুষলধারে বর্ষণ। আঃ পৃথিবী যেন বাঁচিল। ঠান্ডা ঝড়ো হাওয়ায় ভিজা মাটির সোঁদা সোঁদা গন্ধ উঠিতে লাগিল।’
নোবেল সাহিত্য পুরস্কার কমিটির দুর্ভাগ্য, তারা বাংলার এই ঔপন্যাসিকের খোঁজ বের করতে পারেন নি। তাদের পুরস্কারের খাতায় এই মহান কারিগরের নাম উঠে নি।//
[সংযোজন : তারাশংকর আঞ্চলিকতার ট্যাগ খাওয়া লেখক!]
Leave a Reply