প্রতিদিন ১১ কিলোমিটার দূর থেকে হেঁটে বরিশাল লাইব্রেরিতে এসে বই পড়ে আবার সন্ধ্যায় পায়ে হেঁটে বাড়িতে ফিরে যেতেন তিনি; অন্য পাঁচ-দশটা গ্রাম্য শিশুর মতই অতি দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম তাঁর; সামান্য ভিটেবাড়ি ছাড়া উত্তরাধিকার সূত্রে কিছুই পাননি তিনি; বাবাকে হারান শৈশবেই।
পিতৃহীন ‘আরজ আলী মাতুব্বর’ মায়ের ছায়ায় বড় হচ্ছিলেন। বাংলা ১৩৩৯ সনে সেই মাকে হারিয়েও প্রচণ্ড আঘাত পান, আরজ আলী তখন যৌবনে দাঁড়িয়ে; মৃত মায়ের একটি ছবি তোলার অপরাধে মায়ের জানাজা হলো না; এক ধাক্কায় আরজ আলী’র মনন থেকে উঠে আসতে শুরু করলো ধর্ম, দর্শন, সমাজতত্ত্ব, জগৎ ও জীবন নিয়ে নানা জিজ্ঞাসা। প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে লাইব্রেরিতে পড়াশোনা শুরু করেন, কিন্তু তাঁর মনে জেগে ওঠে প্রশ্নের পর প্রশ্ন; আলোড়িত প্রশ্নগুলো লিখে রাখতে শুরু করেন, আর এভাবেই লিখে ফেলেন তার প্রথম বই ‘সত্যের সন্ধান’, এটি বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে।
আরজ আলী মাতুব্বর ছিলেন স্বশিক্ষিত বস্তুবাদী দার্শনিক; বিজ্ঞান, ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব সবক্ষেত্রেই ছিল তাঁর আলোকিত পদচারণা, ৮০ তম জন্মবার্ষিকীতে জীবনের সমূদয় উপার্জন দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরি’, মানবকল্যাণে নিজ দেহ ও চোখ দান করে গিয়েছিলেন; জ্ঞানার্জনে শিক্ষার কোনো বিকল্প হতে পারে না – এই সত্যটি উপলব্ধি করে আমৃত্যু জ্ঞানান্বেষণে ছুটে বেড়িয়েছেন তিনি।
মানুষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্বত্তার মূল ভিত্তি হচ্ছে মানবীয় উৎকর্ষতা ও যৌক্তিক-বিশ্লেষণার্থক চিন্তার প্রসারতা। সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত মানুষের চেয়ে তাই আমাদের বেশি প্রয়োজন স্বশিক্ষিত আলোকিত মানুষের। কালের ক্রমবিকাশে লৌকিক স্বশিক্ষিত মানুষেরাই হয়ে দাড়িয়েছেন মহাজাগতিক আলোকবর্তিকা, যাঁরা ছাড়িয়ে গেছেন সময়কে। ‘আরজ আলী মাতুব্বর’ সেই লৌকিক স্বশিক্ষিত দার্শনিক, যাঁর দর্শন এখনো বহুমাত্রিক কুসংস্কারের বেড়াজাল ভেদ করে যৌক্তিক মুক্তির সন্ধান দেয় আমাদের। তাঁর হাত ধরে আজও আমরা খুঁজে নিতে পারি মনুষ্যত্ব, মানবিকতা, বিজ্ঞানমস্কতার উত্তরণ।
‘আরজ আলী মাতুব্বর’-এর ১১৬ তম জন্মদিনে তাঁর প্রশ্নের আলোয় আলোকিত হবার চেষ্টাই হতে পারে আমাদের উত্তরণের ব্রত। শুভ জন্মদিন, অগ্রজ।
ফরম্যাট: পিডিএফ
Leave a Reply