লিখেছেন হুমায়ুন রশীদ
ফেইসবুকে একটা ছবি দেখলাম, ভারতে ইসকন ইফতারি করাচ্ছে মুসলিমদের। তারাবি নামাজের ব্যবস্থাও রাখছে। এর আগে ঢাকার কমলাপুরে বৌদ্ধ বিহারে ইফতার বিরতণের খবর দেখেছি। বিশ্ব নেতাদের রমজানের শুভেচ্ছাবাণী তো প্রত্যেক বছরই দেয়া হয়। এটার চেয়ে বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য – ঈদের শুভেচ্ছা জানায় পোপ। সাধারণ মুসলিমরা একবারও ভেবে দেখে না, কেন তাদের মোনাজাতে কেবল মুসলিমদের শান্তি-সমৃদ্ধি চাওয়া হয়, কেন শুধু ‘বিশ্বের মুসলমানদের’ জন্য দোয়া করা হয়। অন্যান্য ধর্ম যেখানে ‘জগতের সকল প্রাণীর সুখী হওয়ার’ দোয়া চায়? ক্রিসমাস কিংবা ইস্টারে কেন সৌদি গ্রান্ড মুফতি কিংবা ইউরোপের কোনো মসজিদের ইমাম খ্রিষ্টানদের শুভেচ্ছা জানায় না? কেন অমুসলিমদের জন্য ইসলাম দোয়া করতে নিষেধ করেছে? কেন অমুসলিমদের ধর্মীয় উৎসবে যোগ দেয়া নিষেধ করেছে? এসব মানবিক প্রশ্ন তো তাদের মনে আসেই না, উল্টো এইসব বর্বর প্রতিক্রিয়াশীল নিষেধাজ্ঞা নিয়ে তাদের কী গর্ব! কী নির্লজ্জ সাফাই!
ছোটবেলায় দেখতাম বিটিভিতে গীতা পাঠ, ত্রিপিটক পাঠ শেষে বলা হতো, জগতের সকল মানুষ সুখে থাক, শান্তিতে থাক। কিন্তু কুরআন পাঠ শেষে মাওলানা সাহেব বলতেন, বিশ্বের সকল মুসলমান হেফাজত থাকুক, আল্লাহ তাদের সমৃদ্ধি দান করুন, সারা বিশ্বে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করছে, আল্লাহ তাদের পরাস্ত করে ইসলামকে জয়ী করে দিন। ছোট বয়েসেও মনে প্রশ্ন জাগত: হিন্দুরা, বৌদ্ধরা বলছে জগতের সবাই সুখী হোক, শুধু আমরা বলছি, নিজেরা ছাড়া আর কেউ যেন সুখী না হয়! কী রকম ছোটমনের পরিচয় যেন। বড়দের জিজ্ঞেস করে দেখেছি, তারাও অস্বস্তিজনক অবস্থায় পড়ে যায়। যাঁরা সৎ মুসলমান, মানে যাঁরা ভণ্ড নন কিংবা ধর্মটাকে ভাল করে জানেন, তাঁরা বলতেন, অরা হইতাছে কাফের, “অরা তো সারা জীবন দোযগে জ্বলব, ওদের তাই দোয়া করা যাবে না।” এই রকম জবাব শুনে বেশির ভাগ শিশু-কিশোর এতেই অভ্যস্ত ও সন্তুষ্ট হয়। সেই ছাঁদে তৈরি হতে থাকে। তারপর স্কুল-কলেজে ভর্তি হয়ে সহপাঠী হিন্দুকে মুখের ওপর বলে দেয়, “তরা দোযগের আগুনে জ্বলবি সারা জীবন।” এই ছেলে বড় হয়ে নিজে যখন শিক্ষক হবে, সেও ক্লাসরুমে হিন্দু ছাত্রদের বলবে, “তরা তো বেহেস্তে যাবি না।”
দোয়ায় যদি কাজ হতো, আল্লাহ বলতে যদি কেউ থাকত, তাহলে মুসলমানরা থাকত পৃথিবীতে সবচেয়ে সম্পদশালী, ক্ষমতাবান, সুখী ও সমৃদ্ধ। আর তাদের অভিশাপে দুনিয়াতে ভিন্ন ধর্মের কেউ আর আস্ত থাকত না। কাজেই কে প্রার্থনায় কী বলল, কিছুই আসে যায় না বস্তু-জগতের বাস্তবতায়। যেটা হয়, প্রার্থনার ভাষাতে জাত চেনা যায়। কার ঈশ্বর কেমন, সেটা সেই ধর্মের প্রার্থনাতে বোঝা যায়।
আমার লেখাগুলোতে আলাদা করে ইসলাম ধর্ম থেকে অন্য ধর্মকে তুলনা দেয়ার একটা প্রচেষ্টা থাকে। এর কারণটা হচ্ছে – মুসলমানরা যেন আত্মসমালোচনা শুরু করে। পাথরের মূর্তির সামনে বসে প্রার্থনা করা অর্থহীন, তার উদ্দেশে দুধ-ঘি ঢালা অপচয়। তবে সেটা কারুর ক্ষতি করে না। কাউকে মারতে যায় না। তেমনি নামাজ পড়ে কারুর সন্তুষ্টি চাওয়া বোকামী, কিন্তু নামাজ কারুর ক্ষতি করে না, কাউকে খুন করে না, মারতে যায় না। ক্ষতিকর ঐটাই, যেটা মানুষকে মানুষ না ভেবে কেবল ‘মুসলমান’ ভাবায়। ভিন্ন ধর্মের মানুষদের অভিশাপ দেয়া, তাদের ক্ষতি চাইতে শেখানোটাই খারাপ। সেটাই মানুষকে মারতে শেখায়, ঘৃণা করতে শেখায়। ইসলাম ধর্মের সঙ্গে অন্য ধর্মের অনুসারীদের সঙ্গে এটাই তফাত। আত্মসমালোচনা ভিন্ন মুসলিমদের উন্নতির পথ দেখি না।
Leave a Reply