সকালবেলা থেকেই একটি খবর ও একটি ছবি মাথায় ঢুকে আছে। ওসব নিয়ে দুইলাইন লিখে যে ওই দুইটি জিনিস মাথা থেকে বের করে দেব, সে উপায়ও নেই–সারাদিন কামলার ব্যস্ততা।
একটি খবরের শিরোনাম–‘দেশ ছাড়েন, না হয় হেমায়েতপুরে যান: সিনহাকে মতিয়া‘। খবরের সাথে আবার একটি ছবি–বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের মানববন্ধন!
স্রেফ বমি-বমি পাচ্ছিল এসব দেখে।
মতিয়া চৌধুরীর বক্তব্য, “আজকে রায় দিতে গিয়ে আপনি বহু অবান্তর কথা বলেছেন। মতলববাজি ছাড়েন নাই, আপনার মতলবি কথা কী! জাতির পিতাসমূহ। একজন নারীর সন্তানের পরিচয় একজন পিতার মাধ্যমেই। কোনো মহিলা পঞ্চপাণ্ডবের স্ত্রী হতে পারে, সেটা আপনার ব্যাক্তিগত বিষয়।… জাতির পিতা একজনই, আর তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আর কেউ না। আর আপনি এই কথাগুওেলা কোন সময় বললেন সেই আগস্ট মাসে। আপনার মতলবের কোনো সীমা নাই। এতেই আপনি মোটামুটি ধরা পড়ে গেছেন।”
“জাতির পিতাসমূহ”–ফাউন্ডিং ফাদারস–এর আক্ষরিক বঙ্গানুবাদ করে লীগাররা নেমে পড়েছে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার শ্রাদ্ধ করতে। ফাউন্ডিং ফাদারস নিয়ে একটি সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছে ইমতিয়াজ মাহমুদ–ফেসবুক স্ট্যাটাসে। তাই এসব নিয়ে আর নতুন করে ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না। আমি ভাবছিলাম মতিয়ার সাম্প্রদায়িক লেঞ্জাটার কথা। শুধু উনিই বা কেন, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা প্রায় প্রতিটা লীগারের ‘সাম্প্রদায়িক লেঞ্জা’ বের করে দিয়েছেন। ‘লেঞ্জা ইজ ভেরি ডিফিকাল্ট টু হাইড’–কথাটা জামাত-শিবিরের পাশাপাশি লীগারদের বেলাতেও সমান ভাবে প্রযোজ্য। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার এটা অন্যতম বড় অবদান হিসাবে ইতিহাস হয়ে থাকবে আশা করি।
২) আর ছবিটি হলো–
‘রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে আহ্বান খালেদার‘ শিরোনামের একটা নিউজের সাথে আসছে ছবিটি। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়ার এই কথাটা হয়তো রাজনৈতিক। কিন্তু তার রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে গিয়ে গিয়ে এই কথাটা দেখি–‘বাংলাদেশের সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার এলাকায় রোহিঙ্গা পুরুষ-নারী-শিশুরা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য নাফ নদীর বিস্তৃত এলাকা জুড়ে তীরে বসে ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তায় প্রহর গুনছে। এই দৃশ্য অমানবিক, বেদনাদায়ক ও হৃদয়বিদারক।’–ধর্ম, মত, দল, পরিবার, সমাজ, দেশ, জাতি, সীমানা–ইত্যাদির ঊর্ধ্বে যারা উঠতে পারবেন না, তাদের পক্ষে এই কথাগুলো সমর্থন করা কঠিন।
নারীবাদ, সাম্যবাদ, মানববাদ–এগুলার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো–এগুলা আনকন্ডিশনাল–কোনো শর্তের অধীন নয়। এসবের সাথে কোনো ‘তবে-কিন্তু-যদি’র লেঞ্জা লাগানো যায় না। যারা লাগাবে তাদের মানবতা ধর্ম, মত, দল, পরিবার, সমাজ, দেশ, জাতি, সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ। আর সেজন্যই বিশ্ব-মানবতার জয়গান গাওয়া মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা।
নারীবাদ, সাম্যবাদ, মানববাদ–এগুলার আরেকটা বড় সমস্যা হলো–এগুলা কেউ কাউকে শেখাতে পারে না। নিজের ভিতর থেকে উপলব্ধি না হলে এগুলা কারো পক্ষে বোঝা কঠিন। আরো কঠিন হলো নিয়মিত এর চর্চা করে যাওয়া–ধর্মের স্বার্থ, মতের স্বার্থ, দলের স্বার্থ, পরিবারের স্বার্থ, সমাজের স্বার্থ, দেশের স্বার্থ, জাতির স্বার্থ তো আছেই, সেই সাথে নিজের স্বার্থ আর লোভও বিশাল দেয়াল হয়ে দেখা দেয় প্রতিমুহূর্তে। আর এই সব লোকেরাই যখন আবার অন্যদের ‘মানুষ’ হতে, ‘মানববাদী’ হতে উপদেশ দেয়, তখন বিষয়টা এত হাস্যকর লাগে যে কী বলব!
৩) জন্ম থেকে দেখে আসছি আমাদের টিনের ঘর। ছোটবেলায় সেবার আবার নতুন করে, শক্ত করে ঘর বানানো হলো। তখনো গ্রামে অনেকের ছনের চালা ঘর। ঝড়ে উড়ে যায়, না হলে বর্ষায় ফুটা হয়। ঝড় আসার খবর হলেই সবাই এসে আমাদের ঘরে জড়ো হয়। ছোটরা মেঝেতে ঘুমায়, বড়রা বসে-শুয়ে জেগে থাকে চাদর গায়ে দিয়ে। কেউ কেউ জানালার ফাক-ফোকর, টিনের বেড়ার ফুটো দিয়ে উঁকি-ঝুঁকি মারে–বিজলী-চমকালে বাইরের অবস্থা দেখে আর ঝড়ের ধারাভাষ্য দেয়–অমুকের ঘরের চাল উড়ে গেছে, ওইদিকের ওই গাছটা ভেঙে পড়েছে…
বসে থেকে থেকে ক্ষুধা পায়, বাচ্চারা ঘুম থেকে উঠে কাঁদে… বড় বড় কলসিভরা মুড়ি আর গুড়–ধামা ভরে নামানো হয়–সবাই মিলে চিবায় আর ভাবে–বর্ষার আগেই এবার ঘর ঠিক করতে হবে, গরুগুলা কেমনে আছে কে জানে, বাঁশ পাওয়া যাবে তো…, টাকাও তো লাগবে অনেক…। আশ্বাস দিতে হয়–চিন্তা কইরো না, ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
এরা সবাই আমাদের ‘বন্ধু’ নয়, গ্রাম্য-পলিটিক্স এদের হাড়-মজ্জায়–সুযোগ পেলে অন্যের ক্ষতি করতে ছাড়ে না। নারীবাদ, সাম্যবাদ, মানববাদ–কোনো কিছুর সংজ্ঞা জানা ছিল না, কোনো কিছুর শিক্ষা ছিল না, তবুও আবার বিপদে-আপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে আমাদেরই দৌড়ে যেতে হয়… যাওয়া লাগত…
৪) কখনোই কোনো মানুষের মৃত্যুকামনা করি নাই। তবে অবাক হওয়ার বিষয় হলো–মাঝে মাঝে নিজের বাবা-মা’র মৃত্যু কামনা করছি বা করি। জানি এই বেঁচে থাকার মত সুন্দর আর কিছু নেই। তবুও যখন মনে হয়েছে, এদের আর কোনো কিছু দেয়ার এই এই পৃথিবীকে, উলটো বসে বসে পৃথিবীর রিসোর্স ধ্বংস করছে, তখন মনে হয়েছে এদের না থাকাই ভালো।
পরিবার জিনিসটাকেও কোনোদিন পছন্দ হয় নাই। সবসময়ে চেয়েছি পরিবার-সমাজের গণ্ডি ভেঙে বেরিয়ে যেতে, জাতি-দেশের সীমানা ভেঙে সবার সাথে মিশে যেতে–সবচেয়ে বেশি বাধা এসেছে মা-বাবার কাছ থেকে। তারপর বিয়ে-প্রথাটাকে সমর্থন না করলেও দুর্ঘটনাবশত বিয়ে হয়ে যাওয়া, বাচ্চা নিতে না চাইলেও নিতে বাধ্য হওয়া–এসব কিছু নিয়েই কেমন যেন বিরক্ত খুব।
দুনিয়ার কত মানুষের খাবার নেই, কাপড় নেই, ঘর-বাড়ি নেই, চিকিৎসা নেই–আর আমার মা-বাবা কিছু না করেও এসব ভোগ করছে অন্যদের চেয়ে অনেকগুণ বেশি। হয়তো আমি নিজেও–খুব ছোট মনে হয় নিজেকে তখন! আবার বাচ্চাকেও হিংসা লাগে যখন এইসব ছবি দেখি। জন্মের পর মোটামুটি সব বাচ্চারই কমবেশি সমস্যা থাকে। তারও আছে। তবু তার হসপিতাল থেকে বাড়ি আসার জন্য স্পেশাল আয়োজন, তার জন্য আলাদা খাবার, চুষে খেতে সমস্যা হলে স্তন পাম্প করে আলাদা করে দুধ জমিয়ে রাখার ব্যবস্থা, নিয়মিত ডাক্তারের চেকআপ, একেক সমস্যার জন্য আলাদা আলাদা স্পেশালিস্ট, হরেক রকমের খাবারের আয়োজন–যখন যেটা ভালো খায়, তার মায়ের বুকের দুধ না হলে সেজন্য স্পেশাল ব্যবস্থা–খাবার-দাবার–যখন এসব ছবি দেখি (আরেকটি ছবি কিছুদিন আগে দেখেছিলাম–ঝড় আসবে বলে বাচ্চার মাথা পলিথিন ব্যাগ দিয়ে ঢেকে এক পিতা কোলে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছেন), তখন মনে হয় দুনিয়ায় প্রচুর মানুষকে ঠকিয়ে আমরা বেশি বেশি ভোগ করছি, বা আমরা বেশি বেশি ভোগ করছি বলেই অন্যরা কম পাচ্ছে, কেউ কেউ একেবারেই পাচ্ছে না। আবার আমরা না থাকলেও–এমনকি একেবারেও না থাকলে–বাচ্চার দেখাশোনার জন্য নানা রকমের অপশন আছে। কিন্তু…
… ছবিটায় যে দুধের বাচ্চাগুলো দেখা যাচ্ছে–এদের মায়েরা একদিন বা একবেলা ভালো করে না খেতে পারলে তাদের বুকে দুধ আসবে না–এমনই আমাদেরকে বলা হয়েছে হসপিতাল থেকে, ডাক্তারদের কাছ থেকে–আর বুকে দুধ না এলে এই বাচ্চাগুলোর পুষ্টি সাধন ঠিক মতো হবে না… এছাড়া স্পেশাল খাবারের ব্যাপার তো আছেই…– এসব যখন ভাবি তখন কোথায় যেন একটা কষ্ট মোচড় দিয়ে ওঠে। আবার ভাবি–অন্য বাচ্চাদের এই ব্যাপারটা বোঝার জন্যই কি নিজের একটা বাচ্চা থাকার দরকার হয়েছিল? তাহলে যাদের কোনো পরিবার ছিল না, যাদের কোনো বউ-বাচ্চা ছিল না, তারা এসব কীভাবে বুঝেছিল? কীভাবে কী বুঝে তারা নিজের সব লোভ আর স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে অন্যদের জন্য জীবন উৎসর্গ করে গেছে!
৫) পোস্টটা একটু আবেগী হয়ে যাচ্ছে–এমন কথা ছিল না–এজন্য দুঃখিত। আসলে বলতে চেয়েছিলাম যে এই দুনিয়াটা সবার, সমান ভাবে সবার। এখানে ধর্ম, মত, দল, পরিবার, সমাজ, দেশ, জাতি, কোনো কিছুরই সীমানায় কাউকে সীমাবদ্ধ করার অধিকার কারো নেই, বা এভাবে সীমাবদ্ধ হওয়াটাও আসলেই উচিত নয়। আমাদের বেঁচে থাকাটা যেমন সবচেয়ে সুন্দর, তেমনি সুন্দর হোক আর সবার বেঁচে থাকাটাও… সমান ভাবেই বেঁচে থাকুক সবাই, সমান ভাবেই সুন্দর হোক সবার…
Leave a Reply