সেই কবে থেকে পড়ছিলাম…কয়েকবছর আগে–নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস – আদি পর্ব’। এতদিনে মোটামুটি শেষ হলো। আগ্রহ জমছিল বাঙালি হিন্দুদের জাতপাতের কাহিনীর ইতিহাস দেখে। তারপর আগ্রহ একেবারে জমে গেছিল রাধা-কৃষ্ণের কাহিনী পেয়ে। তারপর গীতগোবিন্দ… বৃহদ্বর্ম পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ… যেগুলো কিনা বাংলাদেশেই লেখা হয়েছিল, এবং এই সেদিন… সেন আমলে! মূলত সেন আমলেই বাংলাদেশে বর্তমান ‘হিন্দুধর্মের’ শুরু। তার আগে পাল আমলে তো প্রায় সবাই-ই বৌদ্ধ ছিল। আচ্ছা এ কাহিনী আরেকদিন হবে। এখন রাধার কাহিনী মাথার মধ্যে ঘুরছে। তবে নামাতে সময় লাগবে।
আপাতত একটা ভিন্ন কাহিনী শোনাই–পাদুকা কাহিনী–
“ময়নামতি ও পাহাড়পুরের মৃতফলক-সাক্ষ্যে মনে হয়, যোদ্ধারা পাদুকা ব্যবহার করিতেন; প্রহরী দ্বারবানেরাও করিতেন; এবং সে-পাদুকা চামড়ার দ্বারা তৈরি হইত এমন ভাবে যাহাতে পায়ের কণ্ঠা পর্যন্ত ঢাকা পড়ে। ব্যাদিতমুখ সেই জুতা ছিল ফিতাবিহীন। সাধারণ লোকেরা বোধহয় কোনও চর্মপাদুকা ব্যবহার করিতেন না, যদিও কর্মানুষ্ঠান-পদ্ধতি ও পিতৃদয়িত-গ্রন্থে পুরুষদের পক্ষে কাষ্ঠ এবং চর্মপাদুকা উভয়ের ব্যবহারেরই ইঙ্গিত বর্তমান। সঙ্গতিসম্পন্ন লোকদের মধ্যেও কাষ্ঠপাদুকার চলন খুব বেশি ছিল।” (পৃ. ৪৬০, ২০০১)
অর্থাত তখনও সাধারণ লোকের জুতা পরার প্রচলন ছিল না। আর কর্মানুষ্ঠানে যাদের পরার কথা বলা হয়েছে, তারা নিশ্চয়ই সমাজের উঁচু স্তরের লোক। তবে অন্য একটা জায়গায় ‘ময়ূরপঙ্খী জুতা’র কথা বলা হয়েছে। বাংলা থেকে কেউ কেউ কাশ্মীর যেত পড়াশোনা করতে। তারা সেখানে এই জুতা পরত। এটাও নিশ্চয়ই সম্পদশালী বিশেষ শ্রেণীর লোক।
তাহলে সাধারণ বাঙালিরা জুতা পরা শিখল কবে? ইংরেজ আমলে কি? তবে আমাদের গ্রামের দিকে বছর বিশেক আগে ২০% লোকের স্যান্ডেল ছিল কিনা সন্দেহ। যাদের ছিল, তারাও বিশেষ উপলক্ষ ছাড়া স্যান্ডেল পরত না। আর তখন রাবারের একজোড়া বাটার স্যান্ডেল যদি ৩০টাকা হত, বাটার ডিজাইন নকল করে রুপালি টাইপের আরো কী কী যেন স্যান্ডেল ছিল, সেগুলার দাম ছিল ৮/১০ টাকা। ৯০% লোকে এগুলাই কিনত। ফিতা ছিঁড়ে যেত… কেউ আবার একটাকা দিয়ে নতুন ফিতা কিনে লাগিয়ে নিত, কেউ বা আগুনে পুড়িয়ে জোড়া লাগাত বা ছোট পিন মেরে চালাত আরো কিছুদিন। বিত্তবানদের সর্বোচ্চ ছিল পেছনে ফিতাওয়ালা চামড়ার স্যান্ডেল। জুতা ছিল হাতে গোনা কয়েকজনের, যা সাধারণত ঢাকার মত শহরে গেলে বের করত।
সে চামড়ার স্যান্ডেল বা জুতার সে কী যত্ন! নিয়মিত রোদে দেয়া, বিশেষ অনুষ্ঠানের আগে হাটবারে আলাদা ব্যাগে করে নিয়ে গিয়ে পালিশ করে আনা, একটু ময়লা লাগলে আঙুলে থুথু মেখে পরিষ্কার করা… আরো কত কী! এই এত সাধের জুতা-স্যান্ডেল আবার একই সাথে বাঙালিদের চরম অবজ্ঞা আর ঘৃণার বস্তু। জুতা পায়ে দিয়ে কাউকে সালাম দেয়া যায় না (সালামের আগে জুতা বা স্যান্ডেল একটু হলেও খুলে নিতে হয়), শহিদমিনারে ওঠা যায় না, জুতাচুরির ভয় থাকলেও জুতা নিয়ে মসজিদ-মন্দিরে ঢোকা যায় না, কাউকে জুতা দেখানো যায় না, খালি পায়ে লাত্থি মারলে যত ব্যথাই লাগুক না কেনো জুতা পরা অবস্থায় পা দিয়ে কাউকে স্পর্শ করলে অনেক অনেক গুণ বেশি ব্যথা/অপমান! এমনকি গরীব শাবানার গরীব ভাই জসীমকে একবার বড়লোক আহমেদ শরীফ বলেছিল–জুতা সোনার তৈরী হলেও সেটা পায়ের তলাতেই থাকে, মাথায় তোলা যায় না। ওদিকে আবার দেশের সবচেয়ে ধনী রাজাকার নুলা মুছা জুতা স্যুটকেসে ভরে মাথার উপর তাকে রাখে, দাসীবাদীদের দিয়ে সেই জুতা আবার নিয়মিত মুছামুছিও করায়। বাঙালির এত সব জুতাকাহিনীর আসল বিষয়টা আসলে কী?
বিষয়টা কি এমন–সেই কবে কার জুতায় ময়লা বা গোবর, বা গ্রামেগঞ্জে জুতাপায়ে হাঁটতে গিয়ে হাগুতে মাখামাখি হয়ে গেছিল, ফলে জুতার গায়ে ‘কলঙ্ক’ লেগে গেছিল। সেই থেকে একজনের পায়ের জুতা অন্যজনের কাছে ঘৃণিত? সেই থেকেই কি ঘরে বা ‘পবিত্রস্থানে’ জুতা নিষিদ্ধ হলো?
[অফটপিক : কোরানের গায়ে গু লেগে গেছে! ঘরের মধ্যে বা পবিত্রস্থানে কোরান কবে নাগাদ নিষিদ্ধ হতে পারে বলে মনে করেন?]
মামুন আব্দুল্লাহ
হা হা সেইরাম